বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২২ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : আবারও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর ঘিরে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছে কক্সবাজারের টেকনাফের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায়। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে টেকনাফ পৌর, হ্নীলা, সদর ও সাবরাং এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছেন। এর আগে সর্বশেষ ৩ নভেম্বর ওই এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, মিয়ানমারে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংঘাতে রাখাইন রাজ্যের প্রায় এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এতে পিছু হঠেছে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী। ওরা আকাশ যোগে বিমান থেকে বোমা বর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে স্থল ভাগে আরাকান আর্মির বিপক্ষে যুদ্ধে নেমেছে স্বশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠি গুলো।
টেকনাফ সীমান্ত বাসিন্দারা জানান, মঙ্গলবার রাত ১০টার পর থেকে বুধবার বিকাল ৫ টা পর্যন্ত মংডু শহর এলাকা থেকে বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসতে থাকে। একই সময়ে মিয়ানমারের মংডু এলাকায় রাতদিন যুদ্ধবিমানের চক্কর দিতে দেখেছেন টেকনাফ পৌর, হ্নীলা, সদর ও সাবরাং ইউনিয়নের বাসিন্দারা। ভেসে আসা বিস্ফোরণের শব্দ মংডু শহরের আশপাশের উকিলপাড়া, ফয়েজীপাড়া, সুধাপাড়া, নাপিতের ডেইল, নয়াপাড়া, সিকদারপাড়া ও হারিপাড়া এলাকা থেকে আসছে।
সাবরাং আছারবনিয়ার মোহাম্মদ সাবের বলেন, এমন বিকট বিস্ফোরণের শব্দ কখনো শোনা যায়নি। ফজরের নামাজের সময় বোমার শব্দে থর থর করে কেঁপে উঠে পুরো মসজিদ।
শাহপরীর দ্বীপের গণমাধ্যমকর্মী জসিম মাহমুদ বলেন, নয় মাস ধরে এলাকার মানুষের চোখে ঘুম নেই। দিনের বেলা তো যেমন-তেমন, রাত হলেই বাড়ে দুশ্চিন্তা।মিয়ানমারের সমস্যার কারণে এপারের বাসিন্দারা সবসময় আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। যুদ্ধ বিমানগুলো আমার বাড়ির উপর দিয়ে গিয়ে বোমা নিক্ষেপ করছে এমন মনে হয়। তারা আমাদের আকাশ সীমানা অতিক্রম করছে কিনা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
হ্নীলার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, নাফনদীর জালিয়ার দিয়া ও লাল দিয়া নামে এ দুটি চরে মিয়ানমারের বিদ্রোহী দুটি গোষ্ঠী অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলির পাশাপাশি মংডু শহর থেকে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসছে। সবমিলিয়ে সীমান্তের মানুষগুলো ভালো নেই। সবসময় আতঙ্কের মধ্যে জীবন-যাপন করতে হচ্ছে।
হ্নীলার ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী ও সাবরাং ইউপির চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, বিস্ফোরণের বিকট শব্দে সাবরাং এলাকার বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি কেঁপে উঠছে। লোকজন শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না। বিশেষ করে, শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে খুবই বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা।এরফলে সীমান্তে বসবাসকারি বাংলাদেশিদের নানান ধরনের সমস্যায় ভোগছেন। এ সংঘাতের জেরে কেউ যাতে অবৈধভাবে বাংলাদেশে করতে না পারে সে লক্ষ্যে সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, দীর্ঘদিন নানাভাবে বিভক্ত সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। মুলত গত ৮ নভেম্বর সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠি সমুহ এক গোপন বৈঠক করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বিবাদমান পক্ষ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ) এবং আরও চারটি ইসলামি মহাজ গোষ্ঠীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের নির্মম শিকার রোহিঙ্গারা এবার আরাকান আর্মির নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। আরাকান আর্মির দ্বারা রোহিঙ্গা নির্যাতনের চিত্র মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মমতাকে ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি।
রোহিঙ্গারা মনে করেন, মংডু শহরটি রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও চেতনার প্রতীক। সুলতানি আমলে আরব বণিকদের আগমনের মাধ্যমে এই শহরে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আজ এই শহর আরাকান আর্মির দখলের মুখে, যা রোহিঙ্গা অস্তিত্বের জন্য এক ভয়ানক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মংডু শুধুমাত্র একটি শহর নয়; এটি রোহিঙ্গা জাতিসত্তার মূল প্রতীক, এবং আরাকান আর্মির এই আগ্রাসন তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করার ষড়যন্ত্র করছে। মংডু থেকে জান্তা বাহিনী পালিয়ে যাওয়ার পর সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছে আরাকান আর্মি।
এতে স্থলে রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধে আকাশ থেকে জান্তার বোমা বর্ষণ আরাকান আর্মিকে কিছুটা দুর্বল করে দিচ্ছে।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply