শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১১ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : পেকুয়া উপজেলা সদরের পেকুয়া সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আরিফ। তার বাড়ির বসত ভিটার সাথে লাগোয়া উপজেলা যুবলীগ সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এবং তাঁর ভাই যুবলীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক আজগীরের বসত ভিটা। দুই ভিটার দুই জনের বসত ঘরের দূরত্ব ১২-১৫ ফুটের মধ্যে।
দুই পরিবারের মধ্যে বসত ভিটা এবং জমি সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়টি দীর্ঘদিনের পুরানো। আর এই জের ধরেই গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাত ৮টা ৪৫ এর দিকে নিজ এলাকা থেকে শিক্ষক আরিফকে অপহরণ করা হয়। পরে মুক্তিপণ দাবি করে। ঘটনার পর থেকে স্বজনরা দাবি করে আসছিল, যুবলীগ সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এবং তাঁর ভাই যুবলীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক আজগীর মিলেই শিক্ষককে অপহরণ করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবিত মিলেনি এই শিক্ষক। ১৪ দিন পর দুই ভিটার মধ্যবর্তী পরিত্যক্ত পুকুরে মিলেছে বস্তাবন্দি মরদেহ। যেখানে ইট ভর্তি করে বস্তাবন্দি মরদেহটি রাখা হয়েছিল পুকুরে।
মরদেহ উদ্ধারের পর উত্তেজিত জনতা যুবলীগ সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এবং তাঁর ভাই যুবলীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক আজগীরের বাড়ি এবং মালিকাধিন মার্কেটে ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আংশিক পুড়ে যাওয়ার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। আর এর পরই পুলিশ বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানে বাড়ির একটি কক্ষে রক্তের দাগ এবং হত্যা আলামত পেয়েছে পুলিশ। তার উদ্ধার করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ, র্যাব, নিহতদের স্বজন এবং এলাকাবাসির সাথে আলাপ করে এমন তথ্য মিলেছে।
আর পুরো ঘটনার জন্য স্বজনরা পুলিশের অবহেলাকে দায়ী করেছেন। স্বজনরা বলছেন, নিখোঁজ হওয়ার পর পরই পেকুয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর কয়েক দফায় ফোনে যোগাযোগ করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়। এরপর ১ অক্টোবর মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর জের ধরে ফোন ট্যাকিং করে আরিফের ফোনের লোকেশন পাওয়া গিয়েছিল জাহাঙ্গীরের বাড়ি। কিন্তু পুলিশ বার বার আরিফ স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে গেছে মন্তব্য করে অভিযান করেনি। আর সেই বাড়িতে রক্তের দাগ এবং পুকুর থেকে মরদেহ উদ্ধার বলে দিচ্ছে আরিফ ওই বাড়িতেই ছিল।
নিহত আরিফ পেকুয়া সদরের মাতব্বরপাড়ার মৃত বজল আহমদের ছেলে এবং পেকুয়া সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক। তিনি দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকার পর দেশে ফিরেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেন।
নিহতের বোন ইয়াছমিন আকতার জানান, এলাকায় আরিফের এক মাত্র প্রতিপক্ষ বা বিরোধ ছিল যুবলীগ সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম এবং তাঁর ভাই যুবলীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক আজগীরের সাথে। অপহরণের পর পর সাধারণ ডায়েরি, মুক্তিপণ চাওয়ার পর মামলা দায়েরের পর আরিফের ফোন ট্যাকিং করেছিল পুলিশ সহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর ফোনটি লোকেশন ছিল পাশের বাড়ির এলাকা। কিন্তু পেকুয়ার থানার পুলিশ বার বার এটাকে স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে বলে অবহেলা করা হয়েছে। বার বার অনুরোধের পরও জাহাঙ্গীরের বাড়িতে অভিযান চালায়নি। অথচ অভিযান চালালে আরিফকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হত।
ইয়াছমিন বলেন, পুলিশের রহস্যজনক উদ্যোগের কারণে আমার ভাইকে মৃত পাওয়া গেছে। আমরা শুরু থেকে বলেছি এটার জন্য জাহাঙ্গীর ও আজগীর দায়ি।
এই দুইজনকে কেন দায়ী করা হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের সাথে জমি এবং বসতভিটা সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে। এমন বিরোধের জের ধরেই এমন ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে।
নিহতদের মামা এম কায়সার জানিয়েছেন, অপহরণের পর তাদের সন্দেহ মিলে গেছে। জাহাঙ্গীর ও আজগীর দুই ভাই যে বাড়িতে থাকেন ওই বাড়ির একটি কক্ষে শুক্রবার রাতে পুলিশ রক্তের দাগ ও হত্যার আলামত সংগ্রহ করেছে। মরদেহটি পাওয়া গেছে দুই বাড়ির মাধ্যখানের পুকুরে। পুকুরটি যদিও আরিফের মালিকাধিন এবং পরিত্যক্ত।
আরিফের ছোট ভাই রিয়াদের জানিয়েছেন, ভাবী এবং মায়ের মোবাইলে তার ভাই আরিফের নম্বর থেকে কয়েকবার ফোন করে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পাওয়া গেল মরদেহ। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বার বার গেছি। সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমে জানিয়েছি। কিছুই হল না।
আরিফের মা মেহেরুন্নেছা বলেন, ‘আমরা ছেলেটাকে জীবিত চেয়েছিলাম। পেলাম না। এখন ন্যায় বিচার চাই।
অপহরণের পর আরিফের স্ত্রী মেহেবুবা আনোয়ার লাইজু চট্টগ্রাম মহানগরীর একটি রেষ্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি দাবী করেন জায়গা-জমির বিরোধ নিয়ে তাদের কোনঠাসা করতে ও মুক্তিপণ আদায় করতে তার স্বামীকে অপহরণ করা হয়েছে। অপহরণের পর অজানা ব্যাক্তিরা তার শাশুড়ির মুঠোফোন কল করে আরিফকে জীবিত ফিরে পেতে হলে প্রথমে ২০-২৫ লাখ টাকা, দ্বিতীয় দফায় ৩৫-৬০ লাখ টাকা এবং সর্বশেষ গত ৩ অক্টোবর ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল বলে তার স্ত্রী লাইজু দাবী করেন। লাইজুর দাবী মতে, বেশি টাকা না থাকায় স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখতে নগদ পেমেন্টের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকার দেন। এ ব্যাপারে থানাসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগও দায়ের করা হয়েছিল।
পেকুয়ায় শিক্ষক আরিফুল ইসলামকে অপহরণ, ৩৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি এবং মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় মো. রুবেল খান নামের এক যুবককে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
গ্রেপ্তার রুবেল চাঁদপুর সদর উপজেলার চরপুরচন্ডী গ্রামের হাবিবুল্লাহ খানের ছেলে। রুবেল মুঠোফোন কোম্পানি বাংলালিংক এর মার্কেট ডেভেলপমেন্ট অফিসার (এমডিও) হিসেবে পেকুয়ায় কর্মরত ছিলেন এবং শিক্ষক আরিফের বাড়িতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন।
র্যাব ১৫ এর সিনিয়র সহকারি পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, শুক্রবার ভোরে র্যাব ১৫, ৭ এবং ১১ এর সদস্যরা যৌথ আভিযান চালিয়ে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানাধীন আন্দরকিল্লা কাচাঁ বাজার এলাকা থেকে রুবেলকে গ্রেপ্তার করেছে।
তিনি বলেন, গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে বাড়ি ফেরার সময় আরিফ নিখোঁজ হন। ওই দিন রাতে তার স্ত্রী মেহবুবা আনোয়ার লাইজু পেকুয়া থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন, যার জিডি নং ১০৩৫, তাং ২৮/০৯/২০২৪। এরপর রাত সাড়ে ১২টার দিকে অজ্ঞাতস্থান থেকে অধ্যক্ষ আরিফের নাম্বার থেকে তার মাকে ফোন করে ছেলে অপহরণের শিকার হয়েছে বলে জানানো হয়। পরবর্তীতে রাত ২টার দিকে পুনরায় ফোন করে চট্টগ্রাম নগরীর ফ্রিপোর্ট থেকে ভিকটিমকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হলেও পরদিন ফ্রিপোর্ট এলাকায় গিয়ে মোহাম্মদ আরিফ পাওয়া যায়নি। পরে ভিকটিমের মুক্তির জন্য ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি এবং পরদিন বিকেল ৪টার মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর নতুন ব্রিজ পুলিশ বক্সের সামনে ভিকটিমের স্ত্রীকে যেতে বলেন অপহরণকারীরা। পাশাপাশি তারা হুমকি দিয়ে বলে, “কোন চালাকি অথবা পুলিশ, র্যাব কিংবা আর্মির দ্বারস্থ হলে তোর স্বামীর মরদেহ পাবি”। কিন্তু এরপর আবারও মোবাইল বন্ধ করে দেন অপহরণকারীরা। গত ৩ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত মুক্তিপণের টাকা নিয়ে ভিকটিমের স্ত্রীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রাখে অজ্ঞাতনামা অপহরণকারীরা। এ ঘটনায় ভিকটিমের ছোট ভাই বাদী হয়ে কক্সবাজারের পেকুয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং ২, তাং ০১/১০/২০২৪।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার পরপরই এ বিষয়ে ছায়াতদন্ত শুরু করে র্যাব। একপর্যায়ে ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও অপহৃতের স্বজনদের নিকট কল করে মুক্তিপণ দাবীকারী হিসেবে রুবেলকে শনাক্ত গ্রেপ্তা করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রুবেল অপহরণ ও হত্যাকান্ডের প্রাথমিক পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে একজন এবং অপহৃতের স্বজনদের নিকট অপহৃতের মোবাইল থেকে দফায় দফায় কল দিয়ে ৩৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে বলে স্বীকার করেছে। অপহরণের আগে রুবেল আরিফের বাড়িতে ভাড়া থেকে আরিফের গতিবিধির উপর দীর্ঘদিন যাবত নজরদারিও করে রুবেল। রুবেলকে সংশ্লিষ্ট মামলায় পেকুয়া থানায় সোপর্দ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, রুবেল জড়িত অনেকের নাম বলেছে। এদের ধরতে অভিযান চলছে।
পেকুয়া থানার ওসি সিরাজুল মোস্তফা বলেন, অপহরণের ১৪ দিন পর শিক্ষক আরিফের মরদেহ শুক্রবার নিজ বাড়ির পুকুরে থেকে ভাসমান অবস্থায় বস্তাবন্দি লাশ পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্ত শেষ করে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এব্যাপারে দায়ের করা মামলায় রুবেল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নানা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার কাছ থেকে।
তিনি বলেন, এ ঘটনার জন্য জাহাঙ্গীর ও আজগীর দুই ভাইকে দায়ি করছেন স্বজনরা। তাদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি কক্ষে রক্তের দাগ ও আলামত পাওয়া গেছে। এটা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে এই দাগ কার রক্তের।
স্বজনদের অভিযোগের ব্যাপারে ওসি বলেন, পুলিশের কোন অবহেলা ছিল না। শুরু থেকে গুরুত্ব সহকারে পুলিশ বিষয়টি নিয়েছে। এ ঘটনায় যাদের দায়ী করা হচ্ছে, যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে তাদের ধরতে অভিযান চলছে।
এদিকে, শনিবার বিকাল ৫ টায় নিহত শিক্ষক আরিফের জানাজা নামায পেকুয়া শহীদ জিয়া ক্রীড়া কমপ্লেক্স মাঠে অনুষ্টিত হবে বলে পরিবার সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply