বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৬ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের তিন শতাধিক বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী বড় ক্যাং (বৌদ্ধ বিহারটি) এখন কোন চিহ্নই যে নেই। গত ১৪ বছরে দখলদারদের থাবায় এটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিহারটির অধিকাংশ জায়গার পাশাপাশি নানা স্থাপনা বেদখল হওয়ায় আচার-অনুষ্ঠানসহ কোন ধরণের কার্যক্রম হয় না।
অথচ এক সময় বিহারটিতে পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন ও ১৯ টি বুদ্ধ মূর্তি থাকলেও এখন ক্ষত চিহ্নেরও দেখা মিলে না। তবে বিহারটিতে এখনও একটি ছোট্ট টিন ঘরে ২ টি বুদ্ধ মূর্তির অংশ বিশেষ এখনও রয়েছে। যা প্রমাণ করে এক সময় এখানে সুপরিসর জায়গা জুড়ে একটি বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্ব ছিল।
দলিল-দস্তাবেজ সহ সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, বিহারের ১৩ একর জায়গার মধ্যে কোন মতে বিহারটির ২ টি মূর্তি ঘিরে ২ একর পাহাড়ী জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে। বেদখল হওয়া অপর ১১ একর জায়গায় দখলদাররা ঘর, ভাড়া বাসা ও খামারসহ অন্যান্য কিছু করে দখল করে নিয়েছে। বিহারের কাজে এক সময় ব্যবহৃত পুকুরটিও এখন অন্যের দখলে। যেখানে চলছে মাছ চাষও।
বিহারের জমিতে ২০০৯ সালের পর সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত মোহাম্মদ আলী নিজস্ব একটি খামার ঘরের সাথে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হ্নীলা কলেজ নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে কলেজটি বন্ধ হয়ে গেলেও ওখানে এখনও নাফ এগ্রো ফার্ম নামের প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে। কলেজের স্থাপনার কয়েকটি ঘর এখনও রয়েছে। তাও খামারের কাজে ব্যবহার হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
এভাবে দখলদারদের থাবায় টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের এক সময়ের ক্যাংপাড়াটি এখন কেবল কালের সাক্ষি হয়ে রয়েছে কোন রকমের।
নানা উদ্যোগ, নানা পদক্ষেপ ও প্রশাসনের একাধিক তৎপরতায়ও এটির শেষ রক্ষা হয়নি। গত ১৪ বছর ধরে বিহার পরিচালনা কমিটি এবং বিহার রক্ষা কমিটির পক্ষে মিছিল, মানববন্ধন, বিবৃতি থেকে শুরু করে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ঢাকা সহ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিকবার পরিদর্শনে গেছেন ঘটনাস্থলে। কিন্তু না শেষ পর্যন্ত বিহারটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল নীরবে-নীরবে।
বিহারটি দখলের বিষয়টি ১৪ বছরের পুরো গল্পটি মনে করে দেয়ার জন্য ২০১১ সালের ৩ মে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার একটি প্রতিবেদনই যথেষ্ট। ওই সময়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনম নাজিম উদ্দিন কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের একই বছরের ১৭ ফেব্রæয়ারি তারিখে প্রেরিত একটি স্মারক সূত্রে প্রতিবেদনটি দাখিল করে ছিলেন।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছিল, বিহারটির পুরোহিত উপিঞ ওয়াংশ মহাথেরো ২০০১ সালে উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (প্রয়াত) মোহাম্মদ আলীর সাথে একটি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে চুক্তি করেন। যে চুক্তিতে বিহারের ২ একর জমিতে গাছ রোপণ করে লাভের অংশ ভাগ করার কথা রয়েছে। একই ভাবে ২০০৯ সালে বিহারের পুরোহিত উ কুশল্যা মহাথেরোর সাথেও মোহাম্মদ আলী বিহারের অন্যান্য জমিতে গাছ রোপনের জন্য আরও একটি চুক্তি করেন।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট বিহারটিতে মুখোশধারী কিছু ব্যক্তি হানা দেন। তারা বিহারের পুরোহিতকে হুমকি দিলে তিনি পালিয়ে যান। ওই দিন বিহারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মালামাল লুট হন।
মূলত ওই দিন থেকে বিহারটি দখল বা নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে প্রতিবেদনটি সূত্রে বলা যাবে। কেন না প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরোহিত পালিয়ে যাওয়ার পর আর প্রাণের ভয়ে বিহারে পুরোহিত সহ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কেউ বিহারে আসেননি। ওই দিন বিহারের মালামাল লুট হওয়ার পাশাপাশি বিহারের বড় বড় কিছু গাছও দখলদারের লোকজন কেটে নিয়ে যাওয়া হয়।
এব্যাপারে বিগত ২০১০ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রশাসনের একাধিক দপ্তরের লিখিত অভিযোগের পরও আইনগত কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। যদিও প্রতিবেদনটিতে ডাকাতিতে জড়িত ১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিহারটি রক্ষার জন্য চিহ্নিত দখলদারদের উচ্ছেদ করে বিহার কর্তৃপক্ষকে জায়গা বুঝিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল।
গত ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর এসে টেকনাফ উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল মামুন আরেকটি প্রতিবেদন ধরেই ৩১ দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলার দায়ের করেন। যে মামলায দখলদারদের উচ্ছেদের আদেশও দেয়া হয়।
মামলার মতে, যেখানের ৩১ দখলদার হলেন, টেকনাফের হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী, ওসমান গনি, রহিমা খাতুন, আবদুস ছালাম, জহুরা খাতুন, হাসিনা খাতুন, নুরুল ইসলাম, আবদুল ওয়ারেছ, পেটান আলী, জলিল আহমদ, মো. কায়সার, আবুল কালাম, মকবুল হোসেন, বাদশা মিয়া, হাবিবুর রহমান, ওসমান সওদাগর, আবদুল্লাহ, কফিল আহমদ, মো. হাছন, ছৈয়দ হোছন, নবী হোছন, সোনা মিয়া, হাবিবুর রহমান, আবু ছিদ্দিক, ইসমাইল মিস্ত্রি, আবদুল গফুর, রশিদ আহমদ, মো. এলাহাত, মো. আলমগীর, খাইলুল বশর, বেলাল উদ্দিন।
বৌদ্ধবিহার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ও আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা কমিটির সহসভাপতি ক্যা জ অং বলেন, ওই সময়ের ৩১ দখলদারের সংখ্যা এখন ক্রমাগত বেড়েছে। গত ১৪ বছর ধরে সরকারের একাধিক তদন্ত কমিটি জমির ধরণ ও পরিমাণ চিহ্নিত, সীমানা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট দখলদারদের তালিকা করে তাদের উচ্ছেদ করার সুপারিশ করে। তদন্তের আলোকে উচ্ছেদ করে বিহারের ভূমিটি পরিচালনা কমিটির কাছে হস্তান্তরে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা থাকলেও সংশ্লিষ্টদের কোন পদক্ষেপ ছিল না। ফলে এখন প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে পুরো জায়গা।
দখলদারদের নিয়ন্ত্রক সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ ছেলে হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মন্তব্য করে ক্যা জ অং বলেন, “বর্তমানে বিহারের আশে-পাশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন যেতও ভয় করেন। সর্বশেষ উচ্ছেদ মামলার আদেশ মতে জায়গাটি উদ্ধারের জন্য গত ৩ মার্চ জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত আবেদনও জানানো হয়েছে। কিন্তু উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়নি।”
এ বিষয়ে সাবেক সংসদ মোহাম্মদ আলীর ছেলে হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহামুদ আলী বলেন, ২০০১ সালে তার বাবার সঙ্গে বিহারের পুরোহিতের একটি চুক্তি হয়। যার শর্ত ছিল, বাবা গাছ লাগাবেন এবং লাভের অংশ সমানভাবে ভাগাভাগি করা হবে। যেহেতু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক তা চান না তখন আমরা দখল ছেড়ে দেব। যে কেউ এসেই বিহারের খালি জায়গায় বিহারের কাজ পরিচালনা করতে পারেন। বিহার তৈরিতে আমি বারবার সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিচ্ছি। আমরা যে গাছ লাগিয়েছি তাও বিহারকে দিয়ে দেব। অন্যান্য দখলদারদের উচ্ছেদে প্রশাসনকে সহযোগিতা করবো।
এ ব্যাপারে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, এ সংক্রান্ত আবেদন পাওয়া গেছে। তবে রেকর্ড না দেখে এই বিষয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
.coxsbazartimes.com
[…] এব্যাপারে গত ২২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার টাইমসডটকম এ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত […]