বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ অপরাহ্ন
আর একজন রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া হবে না বলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পরিস্কার ঘোষণা দেওয়ার পরও নাফনদী ও সাগর উপকুলের অর্ধশত ঘাট দিয়ে দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। আগে আশ্রিত প্রায় ১৪লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মিয়ানমারের আরাকানে, এখন রাখাইন রাজ্যে আরকান আর্মির সাথে জান্তা বাহিনীর প্রবল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আবার বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহন করার চেষ্টা করছে। ইউএনএইচসিআর এর অনুরোধ সত্তে¡ও বাংলাদেশ আর রোহিঙ্গা গ্রহন করবে না বলে সাফ জবাব দিয়েছে।
পঞ্চাশ বছর আগে থেকে বার্মার সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করে আসছে। ১৯৭৮ সালে ও ১৯৯২ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে অমানবিক নির্যাতন করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। তখন তারা আর্ন্তজাতিক প্রতিক্রিয়া দেখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়েছিল,নিজেদের বাড়ীতে পুনরায় বসবাস করার সুযোগ দিয়েছিল। একই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে আবার বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ,গণহত্যা,ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বাড়ীঘর, স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করতে থাকলে জাতিসংঘ ও বিশ্ববাসীর অনুরোধে শেখ হাসিনার সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সীমান্ত খুলে দেয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এতদিন যে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল সেই সুযোগ পেয়ে একবারে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুৎ করে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়। অনেকে বলেন বাংলাদেশের পক্ষে সীমান্ত খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া না হলে বর্মী সেনারা এত বেশী রোহিঙ্গাকে এক সাথে তাড়িয়ে দিত না। শেখ হাসিনা মানবতার মা খেতাব ও নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য গণহারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ আছে। এখন কক্সবাজারের মানুষ তথা বাংলাদেশের মানুষ আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে খুবই বিরক্ত ও আতংকিত হলেও তখন সাধারণ মানুষও রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন। বাংলাদেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি,ইয়াবা,মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচারের জন্য প্রধানত আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দায়ী করা হয়। শিবিরগুলোতে সশস্ত্র আরশা ও আরএসও বাহিনীর মধ্যে প্রায় সংঘর্ষ হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। সশস্ত্র গ্রæপগুলো শিবিরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে মানব পাচার,অস্ত্র ও মাদক বাণিজ্য অব্যাহত রাখার স্বার্থেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয় বলে অভিযোগ আছে।
মিয়ানমারে বর্তমানে চলমান গৃহযুদ্ধে আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের অনেকগুলি সেনাছাউনীসহ অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে ফেলেছে ও জান্তাবাহিনী হারানো দখল পুনরুদ্ধার করার জন্য ভারী অস্ত্রের গোলা বর্ষণ ও বিমান হামলা করছে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লাগাতার গৃহযুদ্ধে সেনাবাহিনী ব্যাপক লোকবল ক্ষয় হলে জান্তা সরকার তরুণদের সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামুলক ঘোষণা করে আইন কার্যকর করে। কিন্তু বার্মিজ নাগরিকরা সরকারের ডাকে সাড়া না দিয়ে গোপনে দেশত্যাগ করছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের স্বীকৃতমতে বৈধ নাগরিক নয় বিধায় সেনাবাহিনীতে যোগদান তাদের জন্য বাধ্যতামূলক হতে পারে না। তারপরও অনেক রোহিঙ্গা তরুণ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে শরীক হয়েছে এবং যুদ্ধে নিহত হয়ে প্রমাণ দিয়েছে তারা জন্মগতভাবে মিয়ানমারের নাগরিক,দেশ রক্ষায় তাদের দায়িত্ব আছে ও তাদের দেশপ্রেম আছে। আরশা ও আরএসও জান্তা সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আরকান আর্মি যুদ্ধে অগ্রগামী থাকলেও মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারে আছে সেনাবাহিনী যারা লাগাতার ৫০ বছরের অধিক কাল ক্ষমতায় আছে। বিদেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা ও আইন প্রনয়ণ,অধ্যাদেশ জারী করার ক্ষমতা এখনও সেনাবাহিনীর হাতেই আছে। আরাকান আর্মির তা নাই বা আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি নাই। বিপদের দিনে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য রোহিঙ্গা আরশা,আরএসও জান্তা বাহিনীর অনুরোধ রক্ষা করে অংশ গ্রহন করেছে,সম্মূখ যুদ্ধে প্রাণ দিচ্ছে। এখনই মিয়ানমারের জান্তা সরকার ১৯৮২ সালের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণকারী কালা কানুন বাতিল করে আবার অবহেলিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে আইনত কোন বাধা নাই এবং অতি সহজেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনরায় ফেরত দিতে পারে। আরশা ও আরএসও সহ সকল রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে অনুরোধ করা এখনই উপযুক্ত সময়।
আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কেউ বাংলাদেশে আনে নাই বা আসতে বলে নাই,তারা আত্মরক্ষার অজুহাতে বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় অনুপ্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে আইন বা অধ্যাদেশ জারী করলে রোহিঙ্গারা যেভাবে স্বদেশ ত্যাগ করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে, ঠিক সেভাবে স্বেচ্ছায় নিজ দেশে,গ্রামে,বাড়ীতে ফিরে গিয়ে নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে বসবাস করা শুরু করবে। জাতিসংঘ বা অন্য কোন রাষ্ট্র কখন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন করবে তার জন্য অপেক্ষা করবে না।
লেখক : একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা, সাবেক পিপি ও সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply