শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৯ পূর্বাহ্ন
নুপা আলম : মিয়ানমারের বুচিডং এলাকার বৃদ্ধ হাকিম আলী (৫০) জানেন না তার স্ত্রী, ৫ ছেলে ও ২ কন্যার কোন খবর। টানা চেষ্টার পর গত ৪ আগস্ট রাতে মিয়ানমার থেকে ট্রলার যোগে নাফনদী সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফের নয়াপাড়ার ২৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই ব্লকের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। একটি দালাল চক্রের হাতে মিয়ানমারের মুদ্রা ৫ লাখ কিয়াt দেয়ার পর তাকে মিয়ানমারের প্যারাংপুরু এলাকায় নৌকায় উঠার সুযোগ দেয়া হয়। ওই নৌকায় ওই দিন তাঁর সাথে কম হলেও ১০ জন এসেছেন।
রবিবার টেকনাফের নয়াপাড়ার ২৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আলাপকালেই এমন তথ্যের কথা স্বীকার করেছেন হাকিম আলী। ওই ক্যাম্পটি গত এক সপ্তাহে নতুন করে আসা অন্তত ৩ শত রোহিঙ্গা রয়েছে।
হাকিম আলী জানান, মিয়ানমারের জান্তা ও আরাকান আর্মির লড়াইয়ে তার বাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার পর স্ত্রী ও সন্তানদের খবর জানেন না। তিনি মংডুর কাছা-কাছি আসলে আরাকান আর্মির সদস্যরা তাকে আটকে রাখে। তাদের ক্যাম্পে নির্যাতন করে নানা বিষয় জিজ্ঞাসা করা হয়। নানাভাবে ক্যাম্পে তিনি টানা ৩ মাস ছিলেন। তাকে ছেড়ে দেয়ার পর ১০-১২ দিন চেষ্টার পর ক্যাম্পের এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় টেকনাফের এক দালালের সাথে আলাপ করেন। ওই দালালের দেয়া তথ্য মতে প্যারাংপুরু এলাকায় নাফনদীর প্যারাবনে অবস্থান নেন। নৌকা নিয়ে দালালরা যাওয়ার পর মিয়ানমারের ৫ লাখ কিয়াt নগদ দিলে নৌকা তুলে এপারে নিয়ে আসেন। এরপর লুকিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছেন।
হাকিম আলী জানান, তার ৭ ছেলে মেয়ে জীবিত থাকলেও স্ত্রী বোমার আঘাতে মারা গেছেন বলেন শুনেছেন। ওখানে দুই পক্ষের সংঘাতে অনেকেই হতাহত হচ্ছে। অন্যান্য রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে এদিক ওদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বেশি ভাগই সীমান্তে জড়ো হয়েছে, এরাও বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চায়।
একই ক্যাম্পে আলাপ হয়েছে মংডু শহরের নিকটবর্তী এলাকার বৃদ্ধা রাহানুমাি আকতার (৫২) এর সাথে। তিনিও মিয়ানমারের ৫ লাখ কিয়াট নগদ দেয়ার পর দালালের সহায়তায় টেকনাফ পৌঁছেন ৪ দিন আগে।
তিনি জানান, ২০১৭ সালে তার ছেলে বাংলাদেশে এসে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি স্বামী সহ বাড়িতে থাকলেও সংঘাতে উভয় পক্ষের গোলা-বরুদে বাড়ি পুঁড়ে গেছে। স্বামী কোথায় আছেন জানেন না। পালিয়ে ছেলের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন।
ওই ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া ৩ শত রোহিঙ্গার মধ্যে ৩০-৩২ জন রোহিঙ্গা স্বীকার করেছেন মিয়ানমারের ৫ থেকে সাড়ে ৪ লাখ কিয়াট দেয়ার পর দালালরা নৌকায় তুলে তাদের টেকনাফ নিয়ে আসছে।
নয়াপাড়া ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ই ব্লকের কমিউনিটি নেতা (মাঝি) নুরুল আলমও স্বীকার করেছেন ওখানে নতুন রোহিঙ্গা আসার বিষয়টি। তিনি জানান, নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের শেডে আশ্রয় নিচ্ছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনো তাদের তালিকা বা খোঁজা হচ্ছে না।
রবিবার বিকালে উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে নতুন আসা রোহিঙ্গা হাবিব উল্লাহর সাথে আলাপ হয়েছে। তিনিও স্বপরিবারে আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে। তবে তারা আসার আগে তার বাবাকে হত্যা করেছে আরাকান আর্মি।
তিনি জানান, তার বাবাকে হত্যার পর তারা প্রাণ বাঁচাতে নৌকা নিয়ে নাফনদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। মংডুর উত্তরের একটি গ্রামে তার বাড়ি, সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। একের পর এক বোমা নিক্ষেপের কারণে এলাকার চিত্র পর্যন্ত পাল্টে যাচ্ছে। প্যারাংপুরাসহ নাফনদীর পাড়ের বেশকিছু গ্রামে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকার অপেক্ষায় আছে।
এর আগে শুক্রবার ভোরে টেকনাফের একটি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারি কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবারের সাথে আলাপ হয়েছে প্রতিবেদেকের। টেকনাফের একটি পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান করা রোহিঙ্গা পরিবারের অনেক সদস্যই কাঁন্না করছিলেন।
তারা বলেছেন, মংডু শহরের দলিয়াপাড়া ও সুদাপাড়া এলাকা এখন রোহিঙ্গা শূন্য। ওখানে উভয় পক্ষ শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমা, মর্টার শেলের পাশাপাশি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তাতে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছেন। প্রাণ রক্ষায় যে যে দিকে পাচ্ছেন পালাচ্ছেন। দালালদের জনপ্রতি বাংলাদেশী ২০ হাজার টাকা দিয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এখন ক্যাম্পে প্রবেশের চেষ্টা করছেন।
ওই সব রোহিঙ্গা বলছেন, লাখের কাছা-কাছি রোহিঙ্গা সীমান্ত জড়ো হয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশী ১ টাকায় মিয়ানমারের মুদ্রায় ১৭ কিয়াটের বেশি। ওই হিসেব মতে জনপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকায় দালালরা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে সহায়তা করছেন।
আরাকান সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান ডা. জুবায়ের বলেন, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ক্রাইসিসকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে আজকের দিনের এই চিত্র দেখতে হচ্ছে। মূলত আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনী লড়াই দেখিয়ে রোহিঙ্গা নির্মূল করা হচ্ছে। সেকারণে নিরস্ত্র নিরীহ রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে এদেশে ছুটে আসছে। এতে সমস্যা আরো জটিল হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বোঝা সহ্য করে যাচ্ছে। নতুন করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত না হয় সেজন্য এখনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আওয়াজ তুলতে হবে।
আরাকান রোহিঙ্গা ইয়ুথ কোয়ালিশনের সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, বর্তমানে গণহত্যার দ্বিতীয় পর্ব চলছে। এবারের গণহত্যা ২০১৭ সালের চেয়েও ভয়াবহ। যেসব এলাকায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসতি আছে সেসব এলাকায় আরাকান আর্মি ঘাঁটি করে যুদ্ধ করছে, যাতে করে রোহিঙ্গারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply