শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫ পূর্বাহ্ন
নুপা আলম : কক্সবাজারের বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম নুরুল হক। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানের সারগোদা বিমানঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। ১ জুন সেখান থেকে পালিয়ে দেশে চলে আসেন। ১১ জুন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ১ নম্বর সেক্টরে রণকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেন। ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হলে তিনি সেখানে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সফল কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
স্বীধনতার ৫৩ বছরে এসে প্রায় ৮০ বছরের কাছা-কাছি বয়োবৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম নুরুল হক বীর প্রতীক বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের কাছে আমার চাওয়ার কিছুই নেই। যে স্বপ্ন এবং বিশ্বাস নিয়ে ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে যুদ্ধে গিয়েছিলাম তার বাস্তবায়ন হচ্ছে দেখেই আমি খুশি। আমার চাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে। আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত একটি দেশ। এটার অগ্রযাত্রা দেখেই আমি খুশি।’
সোমবার (২৫ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১ টায় কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের মুক্তারকুল গ্রামের নিজ বাড়িতে বসেই প্রতিবেদকের সাথে আলাপ করেছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি বলেছেন, ‘আমরা যুদ্ধে গিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি। এই দেশটা স্বাধীন করেছি আগামি প্রজন্মের জন্য। যে প্রজন্মটি একটি স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে মাথা উঁচু করে বাস করবেন। যারা যুদ্ধে গিয়ে ছিলেন তাদের অনেকেই আজ নেই। আমিও বেশি দিন থাকবো না। আমারও বয়স হয়েছে। ফলে আগামি প্রজন্মের কাছে আমাদের অনেক বেশি চাওয়া এবং প্রত্যাশা রয়েছে।’
প্রজন্মকে এই দায়িত্ব গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন নুরুল হক বীর প্রতীক বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন একটি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত এবং উন্নয়নশীল বাংলাদেশের কথা। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সুখে এবং শান্তিতে থাকবে। আমরা সেই রাষ্ট্র দিয়েছি প্রজন্মের হাতে। এই প্রজন্মই দেশে-বিদেশে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে, যে স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের হাতে সমর্পন করেছি সেই বাংলাদেশের আদর্শ বিশ্বাস রক্ষা করে রাষ্ট্রকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই বাংলাদেশ যেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজ দায়িত্বে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং রক্ষা করে।
কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের মুক্তারকুল গ্রামে অনুমানিক ১৯৪৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন এসএম নুরুল হক। বাবা শফিকুল হক মাস্টার, মা ছমুদা খাতুন। স্ত্রী জাহান আরা বেগম। তাঁদের পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। বর্তমানে ওই গ্রামেই বসবাস করেন তিনি।
তিনি জানিয়েছেন, মুক্তারকুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখা-পড়া শুরু করেন তিনি। কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন কক্সবাজার সরকারি কলেজে। একাদশ শ্রেণীতে থাকাকালিন সময় ১৯৬৫ সালে যোগদান করেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানের সারগোদা বিমানঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলেই তিনি ১ জুন পালিয়ে আসেন দেশে। প্রথমেই তিনি কক্সবাজার এসেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও পরে তিনি চলে যান ভারতে। যেখানে গিয়ে ১১ জুন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। গ্রহণ করে ১ নম্বর সেক্টরে রণকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ। ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ড শহরে গঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন।
১৯৭১ সালে ৩ ডিসেম্বর তিনি অংশ নেন নিয়েছিলেন প্রথম সফল অপারেশনে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘রাত ১০টার দিকে শুরু হয় প্রথম অপারেশনটি। একটি যুদ্ধবিমান নিয়ে ভারতের নাগাল্যান্ড রাজ্যের ডিমাপুর বিমানঘাঁটি থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। বিমানে আছেন আমি সহ ৩ জন ছিলাম। আমাদের অপারেশনের টার্গেট ছিল চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত তেল শোধনাগারটি ধ্বংস করে দেওয়া। যে তেল শোধনাগার ধ্বংস করা সম্ভব হলে পাক বাহিনী তেল সংকটে পড়বেন। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবেন। আমরা রাত দুইটার দিকে পতেঙ্গার কাছাকাছি পৌঁছে বিমান থেকে তেল শোধনাগারে হামলা শুরু করি। রকেট, বোমা ও মেশিনগান দিয়েই এই হামলা চালানো হয়। পাকিস্তানি সেনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের পলকে শোধনাগারটি দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ওরা যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে নিচ থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমরা অপারেশন শেষ করে নানা কৌশলে ফেনী সীমান্ত দিয়ে ভারতে ফিরে যায়। ওখানে ভারতের বিমান বাহিনীর পক্ষে আমাদের অভিবাদন জানানো হয়েছিল। এর পরও আর কয়েকটি অপারেশন আমরা করে ছিলাম। যা ওই সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।’
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু নিজেই আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বীর প্রতীক খেতাব ঘোষণা করেন জানিয়ে এই বীর যোদ্ধা জানান, ১৯৭৭ সালে বিমানবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। বিমান বাহিনীর নিয়ম মতে ১২ বছর পরে অবসর যাওয়ার সুযোগ আছে আবার আরও ১২ বছর নতুন করে চাকরিতে থাকারও সুযোগ আছে। কিন্তু তিনি আরও ১২ বছরের সুযোগটি নেন নি। ফিরে এসেছিলেন নিজ গ্রামেই। ফেরার পর ১৯৭৮ সালে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি সংস্থার অধিনে চাকরি যোগদান করেছিলেন। ওই চাকরিটি কয়েকমাস করার পর একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখেই আবেদন করে ছিলেন শিক্ষকতার পেশায়। ১৯৭৮ সাথে ২০০৫ পর্যন্ত টানা ২৭ বছর ঈদগাঁও হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এরপর ওখান থেকে অবসরের পর ২০০৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১১ বছর আবারও শিক্ষকতা করেছেন কক্সবাজার শহরের বায়তুল শরফ জব্বারিয়া একাডেমী নামের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
টানা ৩৮ বছর প্রজন্ম তৈরি কারিগর খ্যাত শিক্ষকতা করা এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘কেন শিক্ষকতা করেছেন?’।
উত্তরে তিনি একটু হাসলেন। বললেন, ‘একাদশ শ্রেণীতে থাকাকালিন বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। ওখানে লেখা পড়া করেই ইন্টার পাস করি। ঢাকায় ফিরে ¯œাতক করেছি। এরপর অবসরে এসে বলে হয়েছে শিক্ষকতা একটি স্বাধীন পেশা। একই সঙ্গে আগামি প্রজন্মকে তৈরি করতেও সহায়তা হবে। যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, এই দেশটা প্রজন্মের। প্রজন্ম তৈরি করতে পারলেই দেশ নিরাপদ। আমি সেই নিরাপদ বাংলাদেশে চেয়েছিলাম। আমি মনে করি প্রজন্মরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে আমার এই গৌরবের বাংলাদেশ।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply