বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৭ অপরাহ্ন
এবার সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন(২০২৪-২০২৫) নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে প্রকাশ্যে মারপিট, হামলা, মামলা,আইনজীবী গ্রেপ্তার ও আইনজীবীদের পুলিশী রিমান্ডে নেওয়ার অপ্রত্যাশিত ও নজিরবিহীন ঘটনায় দেশের সাধারণ আইনজীবীরা ও জনগণ খুবই মর্মাহত ও হতাশ। এ দুঃখজনক ও নিন্দিনীয় ঘটনা নিয়ে কয়েক দিন ধরে জাতীয় পত্রিকাগুলো প্রথম পৃষ্টায় অতি গুরুত্ব সহকারে সচিত্র সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রথম আলো ’আইনজীবী সমিতির নির্বাচন’ শিরোনামে সম্পাদকীয় লিখেছে। টিভি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের গণতন্ত্র চর্চার দুর্লভ দৃশ্য প্রচার হয়েছে। বিষয়টি টক-শোর বিষয়বস্তু হয়েছে। ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে হাঙ্গামা সৃষ্টি,ভোট গণনার আগেই একজন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করতে বাধ্য করা,বহিরাগতদের নিয়ে হামলা চালানো,একজন সহকারী এটর্নী জেনারেলসহ অনেকে আহত হওয়ার ঘটনা ছিল খুবই উদ্বেগজনক। সুপ্রীমকোর্টের চারজন সিনিয়র আইনজীবী আমীর উল ইসলাম,শফিক আহমেদ,জেড আই খান পান্না ও ড. শাহদীন মালিক এ ঘটনাকে অত্যন্ত লজ্জাজনক ও দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছেন। পরে তিন জন সহকারী এটর্নী জেনারেলকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতাদের আচার-আচরণ, নীতি-নৈতিকতা, সততা-দক্ষতা, আদালতের নিরপেক্ষ ও পবিত্র ভাবমূর্তি সমুজ্জল রাখায় আইনজীবীদের ভূমিকা এবং আইন-আদালতের প্রতি উচ্চআদালতের আইনজীবীদের দৃশ্যমান শ্রদ্ধাশীলতা দেশের সকল আইনজীবীদের তথা দেশের সাধারণ মানুষের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন পেশাদার আইনজীবী হিসেবে বিগত ৪৫ বছর ধরে লাগাতার এই মহান পেশায় আছি। ১৯৯১ সালে কক্সবাজারের পাবলিক প্রসিকিউটরের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর থেকে দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় ’অতিথি কলাম’ শিরোনাম দিয়ে আইন-আদালত, আইনজীবী,আইনের শাসন,ঘুষ-দুর্নীতি ও সমাজের বিভিন্ন অসংগতি নিয়ে জনস্বার্থে গত ৩৩ বছর ধরে কলাম লিখে আসছি। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তার ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও উচ্চ আদালতের আইনজীবী নেতাদের অপ্রত্যাশিত,দৃষ্টিকটু ও বেআইনী আচরণ সম্পর্কে নিজের মতামত প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছি না।
গত ৩/২/১৯৭৯খ্রিঃ তারিখ আইনজীবী ও কক্সবাজার মহকুমা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে আমার বাবা মরহুম এডভোকেট ফজলুল করিমের বন্ধু সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র এডভোকেট আহমেদ সোবহানের জুনিয়র হিসেবে তাঁর ধানমন্ডিস্থ চেম্বারে যোগদান করি। প্রতি দিন সন্ধ্যার পর আমি উনার চেম্বারে গিয়ে উনার ডিকটেশন নিতাম ও টাইপ করে দিতাম। উনার চেম্বারে সহকারী বেলায়েত মিয়ার কক্ষে টাইপরাইটার ছিল। তখন আহমেদ সোবহানের চেম্বারে জুনিয়র হিসেবে ছিলেন উনার ভাইপো ব্যারিষ্টার মোঃ ফজলুল করিম,জয়নাল আবেদীন,প্রফেসর নুরুল ইসলাম,জিয়াউর রহমান খান। তখন আহমেদ সোবহান বাংলাদেশ জাতীয় আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমদ,কোষাধ্যক্ষ ছিলেন নুরুল ইসলাম।
পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর যে দিন ফাঁসির আদেশ হয়েছিল সেদিন আহমেদ সোবহান খুবই মর্মাহত হয়ে বাংলাদেশ জাতীয় আইনজীবী সমিতির সভাপতি হিসেবে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে ফাঁসির আদেশকে ’বিচারবিভাগীয় হত্যাকান্ড’ বলে অবিহিত করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। সেই বিবৃতি আমি টাইপ করে ঢাকায় অবস্থিত প্রায় সকল পত্রিকা অফিস ও সংবাদ সংস্থার অফিসে উনার জুনিয়র হিসেবে পৌছে দিয়েছিলাম। সে কথা মনে পড়লো কয়েকদিন আগে পত্রিকায় সংবাদ দেখে যে, পাকিস্তান সুপ্রীমকোর্ট ঘোষণা করেছেন যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতি ন্যায় বিচার করা হয় নাই। আহমেদ সোবহান আবদুল করিম সাহিত্যবিষারদ এর ভাইপো ও ড. আহমদ শরীফের ভাই। আহমেদ সোবহান ১৯৭২-৭৩ এবং ১৯৭৬-৭৭ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। উনার ভাইপো ব্যারিষ্টার মোঃ ফজলুল করিম ১৯৮২-৮৩ সালে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে মোঃ ফজলুল করিম বিচারপতি হয়ে অতি সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহন করেছেন। প্রধান বিচারপতি মোঃ রুহুল আমিনও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির ১৯৮০-৮১ সালের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তখন এমন যোগ্য, মেধাবী, সৎ আইনজীবীকে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হতো যারা যোগ্যতার বলে পরে বিচারপতি হয়েছেন,প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত হয়ে নিজের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
এডভোকেট শামসুল হক চৌধুরী ১৯৭২-৭৩ সালে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৮৩-৮৪ থেকে শুরু করে ১৯৮৮-৮৯ পর্যন্ত লাগাতার ৬বার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামাতে ইসলামীর আইনজীবী নেতারা এক সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সফলভাবে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন। এখন সুপ্রীমকোর্ট এর আইনজীবী নেতাদের পরস্পর বিরোধী হামলা,মামলা,মারামারি ও পরস্পরের প্রতি এত শ্রদ্ধাহীনতা ও অসহিঞ্চুতা কেন? আইনজীবীদের একতা,স্বাধীন সত্ত¡া ও স্বাধীন বিবেচনাবোধ লোপ পেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তলপিবাহক হয়ে যাবেন কেন আইনজীবী নেতারা? এতে করে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা জনসমক্ষে প্রশ্নবদ্ধি হচ্ছে না? এই হতাশাজনক আস্থাহীনতার পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে বা কারা? এই আত্মঘাতী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কি সম্ভব নয়? সহজ উত্তর হল, উক্ত পরিস্থিতির জন্য নিলজ্জ দলীয়করণ ও রাজনীতিকরণই দায়ী।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় এরশাদ সরকারের পতনের পর কিভাবে দেশ রাষ্ট্র পরিচালিত হবে সে সংক্রান্তে আন্দোলনরত তিন জোটের মধ্যে স্বাক্ষরিত রূপরেখা পদদলিত করে ১৯৯১ সাল থেকে বিচারাঙ্গণে ও আইনজীবীদের মধ্যে দলীয়করণ নীতি শুরু করা হয়। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী দল,আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও ইসলামী আইনজীবী পরিষদ ইত্যাদি নামে আইনজীবীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে দলীয়করণ শুরু করা হয়। দলভুক্ত হলে সহজে আইন কর্মকর্তা,আইন উপদেষ্টা,বিচারপতি হওয়ার সুযোগ পাওয়ার লোভে অনেক আইনজীবী দলীয়করণের অংশীদার হয়েছেন। তখন দলভুক্ত আইনজীবীরা মূল রাজনৈতিক দলের নেতাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য থাকেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন ছলে,বলে,কৌশলে, আইনী-বেআইনী যে কোন উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় থাকার নীতি চালু আছে তা আইনজীবীদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে। মূল রাজনীতি নীতিহীনতামুক্ত,হাঙ্গামামুক্ত,দুর্নীতিমুক্ত না হলে দলীয়করণকৃত আইনজীবী দলগুলোর নেতৃত্বে আইনজীবী সমিতিগুলোর নির্বাচনও হাঙ্গামামুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, হস্তক্ষেপমুক্ত,অবাধ,নিরপেক্ষ করা কঠিন হওয়াই স্বাভাবিক।
আদালত প্রাঙ্গণকে সম্পূর্ণ রাজনীতিমুক্ত করতে হবে। আইনজীবীরা অবশ্যই রাজনীতি করবেন,নেতা হবেন,এমপি হবেন,মন্ত্রী হবেন তাদের রাজনৈতিক দলের অফিসে গিয়ে রাজনীতি করে। আদালত প্রাঙ্গণ বা আইনজীবী সমিতিকে ব্যবহার করে নয়। আইনজীবী সমিতির নির্বাচন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে হবে। আইনজীবী সমিতির সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক সহ অন্য কর্মকর্তা নির্বাচিত হবেন ব্যক্তিগত যোগ্যতা অনুযায়ী, শুধু রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে নয়। আইন কর্মকর্তা,আইন উপদেষ্টা,বিচারপতি নিযুক্ত হবেন সততা,যোগ্যতা,দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা বিবেচনা করে,শুধু রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনা করে নয়। এমন যোগ্য আইনজীবীদের নিয়োগ করতে হবে যাতে পরে অব্যাহতি দিতে না হয়। কাজগুলি করতে হলে প্রচলিত আইন পরিবর্তন করতে হতে পারে। যে প্রখ্যাত আইনজীবীরা বা নেতারা যারা হীনস্বার্থে দলীয়করণ শুরু করেছিলেন ইতিমধ্যে তাদের অনেকের মৃত্যু হয়েছে সেই দলীয়করণের কুফলের শিকার হয়ে অসম্মান, অশান্তি নিয়ে। শামসুল হক চৌধুরী সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির পর পর ছয় বার নির্বাচিত সভাপতি থাকার সময় রাজনীতির উর্ধ্বে গিয়ে আইনজীবীরা একতাবদ্ধ হয়ে যেভাবে গণতন্ত্রের পক্ষে,আইনের শাসনের পক্ষে,ন্যায় বিচারের পক্ষে দাড়িয়েছিলেন আদালত প্রাঙ্গণে ঠিক সেই পরিবেশ ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়। আদালত প্রাঙ্গণে সকল ধরনের দলীয়করণ ও রাজনীতিকরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রশ্ন হল, বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবেন কে?
যার শাসনামলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত অভুতপূর্ব উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়েছে, তিনি বিশ্বে ইতিহাস সৃষ্টিকারী পাঁচবারের নির্বাচিত মহিলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখন একমাত্র তিনিই পারেন আদালত প্রাঙ্গণের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে। আওয়ামী লীগ,বিএনপি ও জামাতের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নন এমন সিনিয়র আইনজীবী/আইনজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় আইন-সংবিধান সংশোধন করে সুপ্রীমকোর্ট সহ দেশের আইন আদালত প্রাঙ্গণকে রাজনীতিমুক্ত, হাঙ্গামামুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত করে বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন তিনি। ইতিহাসে লেখা থাকবে এক নেত্রীর শাসনামলে আদালত প্রাঙ্গণে দলীয়করণ,রাজনীতিকরণ শুরু হয়েছিল,পরিশেষে দেশের স্বার্থে আর এক নেত্রীর শাসনামলে তা আইন করে বন্ধ করা হয়েছে।
লেখক : একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা, সাবেক পিপি ও সাবেক সভাপতি, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply