শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১০ পূর্বাহ্ন
জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়,তাহলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হবে। সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মহান আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। এতে সন্নিবেশিত হয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ এবং রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগের কার্যপরিধিসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ামক বিধানাবলী। সুতরাং সংবিধানের বিধানাবলী সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
অদ্যাবধি,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান পনের বার সংশোধিত হয়েছে। তার মধ্যে সংবিধানের পঞ্চম,সপ্তম এবং ত্রয়োদশ সংশোধন আইন সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক বেআইনী ও অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়েছে। সংবিধানের অষ্টম সংশোধন আইন,১৯৮৮ এর মাধ্যমে সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে রাজধানীর বাইরে হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক স্থায়ী চেঞ্চ স্থাপন এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী গণ্যে উহাও আদালত কর্তৃক বেআইনী ঘোষিত হয়েছে।
তবে সমালোচকরা সব সময় দাবী করেন সংবিধানের সবগুলি সংশোধনী শাসকশ্রেণীর স্বার্থে করা হয়েছিল,জনস্বার্থে নয়। সংবিধানের পঞ্চম ভাগের ৬৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে,’জাতীয় সংসদ’ নামে বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকবে এবং সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইনপ্রণয়ন-ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত থাকবে। একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিন শত সদস্য নিয়ে সংসদ গঠিত হবে এবং সদস্যগণ সংসদ সদস্য নামে অভিহিত হবেন। কেবল মহিলা সদস্যদের জন্য পঞ্চাশটি আসন সংরক্ষিত থাকবে যারা নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। ৬৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হলে এবং তার বয়স পঁচিশ বছর পূর্ণ হলে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার ও সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন। তবে কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বা থাকার জন্য অযোগ্য হবেন যদি তিনি উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতিস্থ ও দেউলিয়া বলে ঘোষিত হন। কোন ব্যক্তি বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করলে বা আনুগত্য প্রকাশ করলে। নৈতিক স্ফলনজনিত অপরাধে অন্যুন দুই বছর কারাভোগ করলে মুক্তি লাভের পাঁচ বছরকাল। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ কলোবরেটারস আদেশের অধিন দন্ডিত হয়ে থাকলে। প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে বা আইনের দ্বারা অনুরূপ নির্বাচনে অযোগ্য হন।
সংবিধানের উল্লেখিত অনুচ্ছেদগুলো বেশী আলোচিত হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামায় প্রদত্ত প্রাথীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কর্তৃক একটি তথ্যচিত্র জনসমক্ষে প্রচার করার পর। প্রকাশিত তথ্যচিত্র নিয়ে দেশের সকল পত্রপত্রিকায় ও মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা,পর্যালোচনা,সমালোচনা করা হচ্ছে। কালের কন্ঠ প্রথম পৃষ্টায় লিখেছে, শতকোটি টাকার মালিক ১৮ প্রার্থী নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ৮২% কোটিপতি। নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোটিপতি প্রার্থী ছিল ২৭%। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ৪৭% কোটিপতি। বিদেশে এক মন্ত্রীর ২,৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা আছে। পাঁচ বছরে এমপিদের আয় বেড়েছে ২২৩৮%, ১৫ বছরে বেড়েছে ৭১১৬%।
কোটিপতি প্রার্থীদের মোট সংখ্যা ৫৭১ জন,এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৩৫জন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের মাত্র ২৭ শতাংশের কিছু বেশী ছিলেন কোটিপতি। মাত্র ১৫বছরের ব্যবধানে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৮২ শতাংশে। কে অস্বীকার করবে যে দেশের আশাতীত উন্নতি হয়েছে,নেতাদেরও উন্নতি হয়েছে । আওয়ামী লীগ সরকারের ছায়াতলে থাকা এককালের অনেক কমিউনিস্ট নেতাও কোটিপতি হয়েছেন। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতির ফলে সাধারণ মানুষ খুব কষ্ঠে আছেন, অনাহারে নাই,তবে অনেকে অর্ধাহারে আছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা প্রথম পৃষ্টায় ’হলফনামায় নয়ছয় গোপনীয়তা’ শিরোনামে লিখেছে প্রার্থীরা হলফনামায় জমির বিঘা ১০০ টাকা,সোনার ভরি ৩০০টাকা,গুলশানের বাড়ীর দাম ৩৪ লাখ,৫ কাটা জমির দাম ৪০০ টাকা উল্লেখ করেছেন। একপ্রার্থী ৫০০ কোটি টাকার বাগানবাড়ী তথ্য গোপন করেছেন। দায়িত্বশীল নেতারা জনগণের সামনে লজ্জিত না হয়ে উল্টা টিআইবিকে তীব্র সমালোচনা করছেন। টিআইবি নিজের থেকে কোন উদ্ভট তথ্য দেন নাই। প্রার্থীরা হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য বিশ্লষণ করেছেন মাত্র। প্রচলিত আইন অনুযায়ী হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দেওয়া বা হলফনামায় তথ্য গোপন করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই বারের নির্বাচনে স্বঘোষিত ৫৭১জন কোটিপতি প্রার্থীর মধ্যে যদি ৩০০ জন নির্বাচিত হন তাহলে কি জাতীয় সংসদ কোটিপতিদের ক্লাব হয়ে যাবে? হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ৫৭.৩৪ শতাংশ প্রার্থীর মূল পেশা ব্যবসা। আইন ও কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন যথাক্রমে ৯.১৭ ও ৭.৮১ শতাংশ প্রার্থী। চাকরিজীবী ৫.১৬ শতাংশ ও শিক্ষক ৪.১৫ শতাংশ। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ২.৭১ শতাংশ,চিকিৎক ২.১৯ শতাংশ, সাংবাদিক ০.৮৩ শতাংশ। রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন মাত্র ২.৮৬ শতাংশ প্রার্থী। সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদের মুল দায়িত্ব ও ক্ষমতা হল আইন প্রণয়ন করা। ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে ও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় এত বেশী আগ্রহ ও বিনিয়োগের আসল কারণ কি? রাজনীতিতে বিনিয়োগ কি সাধারণ কলকারখানায়, ব্যবসায়ে বিনিয়োগের চেয়ে বেশী লাভজনক? বাকী থাকা সামান্য ২.৮৬ শতাংশ রাজনীতিবিদদেরও কি আস্তে আস্তে ব্যবসায়ী বানিয়ে ফেলা হবে? জাতীয় সংসদে কি ব্যবসায়ীদের লাভ ও সম্পদ বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি করে আইন প্রণয়ন করা হবে? জাতীয় সংসদ কি ব্যবসায়ীদের এফবিবিসিআই এর মত সংগঠন বা কোটিপতি ব্যবসায়ীদের ক্লাব হয়ে যাবে? কোটিপতি রাজনীতি ব্যবসায়ীরা শতকোটি, হাজার কোটি, লাখ কোটিপতি হওয়ার চেষ্টায় থাকবেন তা স্বাভাবিক। কারণ অর্থলিপ্সার, সম্পদলিপ্সার কোন সীমারেখা নাই। কোটিপতিরা সব সময় তাদের কোটি কোটি টাকার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকবেন। দেশের ১৭ কোটি সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা কে ভাববেন। চক চক করলে সোনা হয় না। ছলে বলে কৌশলে ভোট নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেই দেশপ্রেমিক, মানবদরদী হওয়া যায় না। জাতীয় সংসদের নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে যেমন ৫০টি সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে সংবিধান সংশোধন করে দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে সংবিধান আবার সংশোধন করতে হবে। দেশের মানুষের জন্যই সংবিধান,সংবিধানের জন্য মানুষ নয়।
লেখক : একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা, সাবেক পিপি ও সাবেক সভাপতি, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply