সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৮ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক : কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত চারজন রোহিঙ্গাকে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে যৌথভাবে ইউএনএইচসিআর ন্যানসেন রিফিউজি অ্যাওয়ার্ডএর আঞ্চলিক বিজয়ী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
এই গল্পকারদের একজনের জন্ম কুতুপালং ক্যাম্পে শরণার্থী হিসেবে, আর বাকি তিনজন ২০১৭ সালে নিরাপত্তা ও আশ্রয়ের খোঁজে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তাঁরা নিজ জনগোষ্ঠীর মানুষের দারুণ সব গল্প খুঁজে বের করেন, এবং স্মার্টফোন ও ক্যামেরার মাধ্যমে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেন।
শরণার্থী জীবনের একেবারে কাছ থেকে নেয়া এই মানবিক চিত্রের মাধ্যমে আবদুল্লাহ হাবিব, সাহাত জিয়া হিরো, সেলিম খান ওশাহিদা উইনরোহিঙ্গাদের চোখে রোহিঙ্গাদের জীবন দেখার এক সুযোগ এনে দেন বিশ্বের কাছে। সেলিম বলেন, “আমার লেন্সে আমি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শক্তি ও সাহসের চিত্র তুলে আনি সারা বিশ্বের কাছে”।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিনিধি (রিপ্রেজেন্টেটিভ) সুম্বুল রিজভী বলেন, “এখানে বলার মত অনেক গল্প আছে। আশার গল্প, ভালোবাসার গল্প, হারানোর গল্প, আর মিয়ানমারে নিজ বাড়িতে ফেরার আকুতির গল্প। এই চারজন শিল্পীর অসাধারণ ছবিগুলোসারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এমন সব অভূতপূর্ব কাহিনী নিয়ে আসে যা ক্যাম্পের বাইরে দেখা যায় না”।
তাঁদের লক্ষ্য বাংলাদেশে থাকা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জীবনে পরিবর্তন আনা। জিয়া বলেন, “আমরা চাই না যে আমাদের কথা বিশ্ব ভুলে যাক। আমি চাই দুনিয়ার মানুষ যেন রোহিঙ্গাদের আর দশটা মানুষের মত ভাবে”। আবদুল্লাহ বলেন, “এই গল্পগুলোর মাধ্যমে আমরা রোহিঙ্গাদের আওয়াজ তুলে ধরার চেষ্টা করি। বিশ্বের সাথে একটি সেতুবন্ধনের চেষ্টা করি”।
এই চারজনের ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিন কিংবা প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রয়েছে তাঁদের হাজার হাজার ফলোয়ার। নিজ জনগণের কন্ঠ তুলে ধরা ছাড়াও, তাঁরা বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে অন্যদের প্রশিক্ষণ দেন। তাঁরা বাড়িয়েছেন রোহিঙ্গা গল্পকারদের সংখ্যা; যাঁরা মনের ভাব প্রকাশে চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র ও কবিতার শক্তি বুঝতে ও ব্যবহার করতে পারেন।জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, ক্যাম্পে নিয়মিত আঘাত হানা আগুন ও বন্যায় করণীয় কাজের তথ্যও তাঁরা বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে পারেন। শাহিদা বলেন, “আমার সমাজে রোহিঙ্গা নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। আমি তাঁদের হয়ে কথা বলতে চাই, তাঁদের জীবন তুলে আনতে চাই আমার লেন্সে, আর আমার কবিতার মাধ্যমে তাঁদের আবেগগুলো জানাতে চাই”।
শরণার্থী, আভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ও রাষ্ট্রহীন মানুষদের সুরক্ষায় অসাধারণ অবদান রাখা ব্যক্তি, দল ও সংস্থাদের ১৯৫৪ সাল থেকেইউএনএইচসিআর-এর ন্যানসেন পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।এখন পর্যন্ত ৬০-এরও বেশি ব্যক্তি, দল ও সংস্থা নিজ ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া মানুষদের জন্য অনন্য সেবা ও অতুলনীয় কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ এই পুরস্কার পেয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মানবিক প্রচেষ্টার কারণে আঞ্চলিক বিজয়ীদেরও এই পুরস্কার দেয়া হচ্ছে।
গতকাল ১৩ ডিসেম্বর জেনেভাতে চলমান বৈশ্বিক শরণার্থী সম্মেলন গ্লোবাল রিফিউজি ফোরামে এক অনুষ্ঠানে এই পুরস্কার বিতরণ করা হয়। রোহিঙ্গা বিজয়ীরা সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকতে পারায়, তাঁদের একটি ভিডিও বার্তা সেখানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দেখানো হয়। তাঁরা চারজন তাঁদের অনবদ্য সেবা ও সংকল্পের জন্য একটি সার্টিফিকেট পান। যদিও এতে কোন আর্থিক পুরস্কার নেই; তবে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাঁদের মানবিক কর্মকান্ডকে ভবিষ্যতে সহায়তা করা হবে।
উক্তিঃ
• আবদুল্লাহ হাবিব (ফটোগ্রাফার, ফিল্মমেকার):“আমরা আমাদের সব হারিয়েছি। এমন কি নিজের দেশও”।
• মোহাম্মদ সেলিম খান (ফটোগ্রাফার):“আমার লক্ষ্য হচ্ছে আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে আনা এবং সেই গল্পগুলো বলা যেগুলো আমার জনগোষ্ঠীকেসাহায্য করতে পারে”।
• সাহাত জিয়া হিরো (ফটোগ্রাফার) :“আমরা চাই না আমাদের কথা বিশ্ব ভুলে যাক। আমি চাই দুনিয়ার মানুষ যেন রোহিঙ্গাদের আর দশটা মানুষের মত ভাবে”।
• শাহিদা উইন (ফটোগ্রাফার, কবি) :“আমি যদি এই মেসেজগুলো বাইরের দুনিয়ার কাছে না নিয়ে আসি, তাহলে আর কে আনবে?”
ইউএনএইচসিআরপ্রসঙ্গে
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর পৃথিবীব্যাপীসংঘাত ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া মানুষদের জীবন রক্ষায়, অধিকার সুরক্ষায়, এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণে কর্মরত একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন।
বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারে সহিংসতা, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লংঘন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন রক্ষাকারী সহায়তা ও বাসস্থান প্রদানে কাজ করে।
মাল্টিমিডিয়া
• বি-রোল ভিডিও
• চারজন রোহিঙ্গা শিল্পীর উপর একটি ছোট ভিডিও:https://www.youtube.com/watch?v=XiG4ZrEB6jg
বিজয়ীদের প্রসঙ্গে
• আবদুল্লাহ (২৯) মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসেন ২০১৭ সালে। তিনি একজনফটোগ্রাফার ও ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার। ২০২২ সালে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল আর্ট কনটেস্ট ফর মাইনরিটি আর্টিস্টস-এ বিবেচিত।
• জিয়া (২৯) মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসেন ২০১৭ সালে। তিনি একজন ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার, ফটোগ্রাফি প্রশিক্ষক, এবং রোহিঙ্গাটোগ্রাফার ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক।
• সেলিম (৩১) কুতুপালং-এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা-বাবা পূর্বে মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে এসেছিলেন। তিনি একজন ফটোগ্রাফার, স্বেচ্ছাসেবী অগ্নি-নির্বাপণ কর্মী, এবং দুর্যোগ মোকাবেলা কর্মকান্ডের প্রশিক্ষক।
• শাহিদা (২৭) মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসেন ২০১৭ সালে।তিনি একজন ফটোগ্রাফার ও কবি, যাঁর গল্পে উঠে আসে নারীর জীবন ও ক্ষমতায়ন। তিনি ২০২৩ সালে বার্ষিক ঢাকা লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল (লিটফেস্ট)-এ অংশগ্রহণ করেছিলেন।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply