মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪১ অপরাহ্ন

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চর্ম রোগের প্রকোপ : জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান এমএসএফ এর

নিজস্ব প্রতিবেদক : কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্ক্যাবিস বা চর্ম (খোসপাঁচড়া) রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøউএইচও) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আনুমানিক ৪০ শতাংশ মানুষ বর্তমানে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত, কিছু কিছু ক্যাম্পে এ আক্রান্তের হারের সংখ্যা ৭০ শতাংশেরও বেশি।

এমতাবস্থায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স/সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দল (এমএসএফ)।

এমএসএফ এর মতে, এ প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য খুব দ্রæত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং ক্যাম্পে বিদ্যমান পানি, স্যানিটেশান এবং স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থার উন্নয়নকেও অর্ন্তভুক্ত করতে হবে।

এমএসএফ বলছে, স্ক্যাবিসের চিকিৎসা প্রক্রিয়াটি সহজ। তবে সময়মত চিকিৎসাসেবা না পেলে এটি মানুষের মাঝে গুরুতর শারীরিক ও মানসিক প্রভাব ফেলতে পারে। সাধারণ চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে রোগীদের ত্বক, জামাকাপড় এবং ঘরে কিছু ঔষধ প্রয়োগ করা যা স্ক্যাবিসের পরজীবিগুলোকে নির্মূল করতে পারে। এ পরজীবীগুলোই সংক্রমণের মূল কারণ। তবে এমএসএফ সতর্ক করছে যে, এ রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে শুধুমাত্র ঔষধ যথেষ্ট হবে না এবং প্রয়োজন হবে প্রাদুর্ভাবের উৎস নির্মূল করা।

বাংলাদেশে এমএসএফ এর মিশন প্রধান কার্স্টেন নোকো বলেন, ‘বর্তমান প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ক্যাম্পে যথাযথ ঔষধের ব্যাপক বিতরণ সর্ম্পকে বারবার আলোচনা করা হয়েছে, তবে এ রোগের প্রাদুর্ভাবের যে মূল কারণ – জনবহুল ক্যাম্পের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – তা মোকাবেলার ব্যবস্থা না নিলে শুধুমাত্র ঔষধ পুনরায় এ রোগের সংক্রমণ রোধ করতে পারবে না।’

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমএসএফ টিম ক্রমবর্ধমানসংখ্যক ত্বকের নানা রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছে। মার্চ ২০২২ এ যখন থেকে ক্যাম্পে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, তখন থেকেই এমএসএফ উচ্চসংখ্যক রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া শুরু করেছে। এ বছরের (২০২৩) জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ক্যাম্পে এমএসএফ টিম প্রায় ৭০,০০০ রোগীর চিকিৎসা করেছে – যা ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

বাংলাদেশে এমএসএফ এর ডেপুটি মেডিকেল কো-অর্ডিনেটর ডা. পঙ্কজ পাল জানান, ‘চিকিৎসা দিতে গিয়ে কিছু কিছু দিন আমরা দিনে প্রায় ৭০০ রোগী দেখেছি।’ ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পরিস্থিতি এমনই ছিল এবং এই ক্রমবর্ধমান রোগী সামাল দেয়ার বিশাল কাজের চাপ সামলেও আমরা বারবার সতর্ক করেছি। এই উচ্চসংখ্যক রোগী সামাল দিতে গিয়ে ২০২৩ এর ফেব্রুয়ারি থেকে রোগীদের নিজ নিজ ক্যাম্পের কাছাকাছি থাকা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলো থেকে চিকিৎসা নিতে বলার সিদ্ধান্ত নেই আমরা।’ এই মুহূর্তে, স্ক্যাবিসের জন্য চিকিৎসা নিতে আসা সব রোগীকে আমরা স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছি না – আমাদের সে সক্ষমতা নেই ’ জানান ডা. পাল।

ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য আজমত উল্লাহ বলেন, ‘গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আমাদের চার বছরের ছেলের স্ক্যাবিস হয়েছে। তার হাতে এবং পরে তার পুরো শরীরে ফুসকুড়ি দেখা যায়। আমরা ডাক্তার এবং ফার্মেসীর পেছনে অনেক অর্থ ব্যয় করেছি। অবশেষে আমার ছেলে সুস্থ হয়েছিল, তবে সে খুব দ্রুত আবারো স্ক্যাবিসে সংক্রমিত হয়। সে খুব একটা ঘুমাতে পারে না রাতে, তার পুরো শরীর চুলকায়, এবং সে ব্যথায় অনেক কাঁদে। আমার বাকি দুই ছেলেরও স্ক্যাবিস এবং আমার ও আমার স্ত্রীর মধ্যেও লক্ষণ রয়েছে। এটা আমার পরিবারের জন্য একটা দু:স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।’

বাংলাদেশে মেডিসিন্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স গত বছর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের পানি ও স্যানিটেশন পরিস্থিতি নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে ; যা থেকে দেখা যায় যে, ক্যাম্পের পানি ও স্যানিটেশন পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। আমরা দেখেছি সেখানে যথাযথ স্যানিটেশনের অভাব এবং পর্যাপ্ত পানির সল্পতা রয়েছে । যদিও আমরা গত দুই বছরে যথেষ্ট পরিমাণে পানি ও স্যানিটেশন কাঠামোর উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছি (পানির নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপন, ক্লোরিনেশন), তবে এগুলো ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। আগের তুলনায় ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার কম । কিছু কিছু এলাকায় প্রতিদিন মাত্র দুই ঘন্টা পানি পাওয়া যায়। এটি মূলত হয়েছে পানির দুর্বল ব্যবস্থাপনা কাঠামোর জন্য। তবে এই ধারণার সাথে পানির ব্যবহারে রেশনিং জড়িত। কারণ বিশ্বাস করা হয় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানীয় সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে – যা এই পানির উৎসগুলির বিশেষ পর্যবেক্ষণ এবং মডেলিং দ্বারা ভুল প্রমাণ করা হয়েছে। গত মাসে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাবানের রেশন প্রতি মাসে দুইটি বার থেকে কমিয়ে একটি করা হয়েছে।

জামতলী ক্যাম্পে বসবাসকারী ১৮ বছর বয়সী শরণার্থী তাহের বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। আমি স্বাস্থ্যবিধির মান বজায় রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু এটা মেনে চলাও বেশ কঠিন। আমরা একই বিছানা, জামাকাপড় এবং দৈনন্দিন ব্যবহার্য সব জিনিস অন্যের সাথে ভাগ করে ব্যবহার করি। এখন আমরা স্ক্যাবিসের ক্ষেত্রেও তাই করছি।’

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খোসপাঁচড়ার প্রাদুর্ভাব এমন একটি সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, যখন তাঁদের জন্য বরাদ্দ কমে যাচ্ছে। হ্রাস পাচ্ছে খাদ্য রেশনিংয়ের পরিমাণ। তহবিল কমে যাওয়ার আগেও, ক্যাম্পের মধ্যে সহায়তা সংস্থাগুলো যে পরিষেবা দিতো তার মাত্রা শরণার্থীদের চাহিদা পূরণ করতে পারতো না। এমএসএফের জন্য বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো যে ক্যাম্পগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক কর্মী এবং ওষুধ সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও মানুষ বিনা বাধায় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারছে না।

নোকো আরো বলেন, ‘ খোসপাঁচড়ার ৪০ শতাংশ হার একটি সতর্কবার্তা। যা আমাদের জানায় যে, ক্যাম্পের স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ঠিক নেই এবং এটি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের কল্যাণকল্পে আরো হুমকি বা ঝুঁকি তৈরি করছে।’

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888