মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৪ অপরাহ্ন

স্বপ্নপূরণের টার্গেট ২০২২ : কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ৬৭ শতাংশ শেষ

বিশেষ প্রতিবেদক : স্বপ্নপূরণের পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের কাজ। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৬৭ শতাংশ। এরই মধ্যে পুরোপুরি শেষ হয়েছে কক্সবাজার অংশে প্রায় ১৩ কিলোমিটার রেলট্রেক বসানোর কাজ। এ ছাড়াও আইকনিক স্টেশন, ছোট-বড় সেতু, কালভার্ট, লেভেল ক্রসিং ও হাইওয়ে ক্রসিংয়ের কাজও পুরোদমে চলমান। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রেল চালুর পরিকল্পনা নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

১২৮ কিলোমিটার প্রকল্প ব্যয় :

রেলওয়ের প্রকল্প সংক্রান্ত নথি অনুসারে, ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। মূল উদ্দেশ্য পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাতায়াত সহজ করা। পাশাপাশি মিয়ানমারসহ ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশকে যুক্ত করা। তবে কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটারের কাজ আপাতত হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এতে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক- এডিবি।

২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি) ও বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এবং চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড পৃথক দুই ভাগে কাজটি করছে। এটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।

প্রকল্প কর্মকর্তা জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৬৭ শতাংশ। করোনার কারণে প্রকল্প মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এই প্রকল্প শেষ করতে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত সময় পাচ্ছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো।

ঝিনুকের আকৃতির স্টেশন :

শুভ্র সাদা বিশাল আকৃতির এক ঝিনুক। এর ভেতরে আসা যাওয়া করবে ট্রেন। এমন দৃশ্য বাস্তব হতে চলেছে সৈকত শহর কক্সবাজারে। দীর্ঘ প্রতিক্ষিত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের আওতায় চলছে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশনের নির্মাণ কাজ। যার ৬ তলা স্টেশন ভবনের মূল কাঠামোর কাজ শেষ হয়েছে।

দোহাজারি-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রজেক্টের (আইকনিক স্টেশন বিল্ডিং) কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মো. আব্দুল জাবের মিলন জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেলপথের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ কক্সবাজারের রেলস্টেশনটি। পুরো স্টেশনটি গড়ে উঠছে ২৯ একর জমির ওপর। আইকনিক স্টেশন ভবনটি ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধার প্রায় সবই থাকছে স্টেশনটিতে।

স্টেশনটি হচ্ছে কক্সবাজার সদর উজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের চাঁন্দেরপাড়া এলাকায়। নির্মাণাধীন স্টেশন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ছয়তলা স্টেশন ভবনের মূল কাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। দিন-রাত কমবেশি ৫ শতাধিক প্রকৌশলী ও শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে স্টেশন ভবনটির নির্মাণকাজে। স্টেশন ভবন ছাড়াও আরও ১৭টি স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে, যেগুলো ব্যবহার করা হবে রেলওয়ের পরিচালনা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে।

শুধু কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনটি নির্মাণ করতেই ২১৫ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রেলের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্টেশনটিতে যাত্রী প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য রাখা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন পথ। থাকছে গাড়ি পার্কিংয়ের বড় জায়গা। আইকনিক রেলস্টেশনটিতে থাকছে তারকামানের হোটেল, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, শিশু যত্ন কেন্দ্র। থাকছে লকার বা লাগেজ রাখার স্থান। রাতের ট্রেন ধরে সকালে কক্সবাজারে গিয়ে পর্যটকেরা লাগেজ, মালামাল স্টেশনে রাখতে পারবেন। আর সারাদিন সমুদ্রসৈকত বা দর্শনীয় স্থান ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ফিরে পারবেন নিজ গন্তব্যে।

দোহাজারি-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রজেক্টের (আইকনিক স্টেশন বিল্ডিং) কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মো. আব্দুল জাবের মিলন বলেন, ছয়তলা আইকনিক স্টেশন ভবনের মূল কাঠামোর নির্মাণ কাজ। এর পাশাপাশি প্লাটফরম ও ফুটওভার ব্রিজের ৩০ শতাংশ কাজ এগিয়েছে। এখন বাকি আছে ফিনিংস, ছাদের কাঠামো তৈরি ও সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজ। ছাদের কাঠামো তৈরির কাজটি এপ্রিল মাসে শুরু হবে। আর ফিনিংসের মধ্যে সেন্ট্রাল ইসি, ফায়ার ফাইটিং, বিএমএ সিস্টেম, সেনিটারি কাজ ও বৈদ্যুতিক কাজ রয়েছে; যা বর্ষা মৌসুমেও কোন ধরণের কাজে সমস্যা হবে না। কারণ ভবনের মূল কাঠামোর কাজ যেহেতু শেষ, ফলে এই কাজগুলো ভেতরে বসে করা যাবে। যার ফলে কাজগুলোও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে। বলা যায়, প্রকল্প মেয়াদের দুই মাস আগে এই আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।

তিনি জানান, সম্প্রতি সময়ে প্রকল্প কাজের অগ্রগতি দেখতে ছুটে আসেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম ও সচিব ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর। তারাসহ রেলের কর্মকর্তারা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এই রেলপথটি চালুর পরিকল্পনা করছেন।

কক্সবাজারে ট্রেন; পাল্টে যাবে অর্থনীতির চাকা :

কক্সবাজারের আইকনিক স্টেশনসহ সব মিলিয়ে নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে রেলপথটিতে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দিকে পরের স্টেশনটি রামু স্টেশন। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন।

চট্টগ্রামের দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন, যা ছিল কক্সবাজারবাসীর জন্য স্বপ্নের মতো। এখন বাস্তবায়নের পথে। স্থানীয়রা বলছেন, কক্সবাজারে ট্রেন চলাচলে পাল্টে যাবে অর্থনীতির চাকা।

রামুর বাসিন্দা সোয়েব সাঈদ বলেন, কক্সবাজারে ট্রেন আসবে, এটা কল্পনাতেও ছিল না। এখন বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে আমরা নিজেরাই বিস্মিত।

সোয়েব সাঈদ আরও বলেন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে অনেকগুণ। যার কারণে এই সড়কে প্রায়শঃ ঘটছে দূর্ঘটনা। যদি এবছরে রেল চালু হলে মানুষের যাতায়াতে অনেক সুবিধা হবে।

হোটেল কক্স-টুডে’র ম্যানেজার আবু তালেব শাহ বলেন, “কক্সবাজারে রেললাইনের কাজ শেষ হলে যখন ট্রেন চলবে; তখন কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। কারণ তখন প্রতিনিধিই কক্সবাজারে পর্যটকের আগমন হবে এবং চাঙা থাকবে পর্যটন ব্যবসা। নতুন করে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও বেশ পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছি।”

সরেজমিন দেখা যায়, কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাহ থেকে রামু উপজেলার জোয়ারিয়া নালা এলাকা পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার রেললাইন বসানো হয়েছে। একই সঙ্গে চলমান রয়েছে স্টেশন ভবনগুলোর কাজও। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত আরও প্রায় ৫০ কিলোমিটার অংশে ১৯টি সেতুর সব কটি তৈরি হয়ে গেছে। ভূমি উন্নয়নকাজও শেষ পর্যায়ে।

নির্ধারিত সময়ের আগে শেষ হচ্ছে ; টার্গেট ডিসেম্বর :

রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোঃ হুমায়ুন কবীর বলেন, এখন র্পর্যন্ত টার্গেট আছে ডিসেম্বর ২০২২ সাল। সেই টার্গেট নিয়ে সমস্ত কাজ এগিয়ে চলছে। আশা করি, ডিসেম্বরের মধ্যে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প কাজ শেষ হবে। রেল লাইনের পাশাপাশি রেল স্টেশনগুলোও আধুনিকমানের সুযোগ-সুবিধায় নির্মিত হচ্ছে। বিশেষ করে, কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন হচ্ছে আন্তর্জাতিকমানের। যেখানে তারকামানের হোটেল, শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, শিশু যত্ন কেন্দ্র, মালামাল রাখার লকার বা লাগেজ রাখার স্থান। ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৬৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888