শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১২ পূর্বাহ্ন
নুপা আলম : এ যেন অনিশ্চিত জীবনের হতাশা গ্রাস করেছে অনন্তকালের জন্য। ফলে স্বপ্নও প্রকাশ করতে ভুলে গেছে স্বামী হারা স্ত্রী বা সন্তান হারা মা। অবুঝ শিশু সন্তানদের নিয়ে কেবল শূন্যতার কথাই বলেছেন স্ত্রীরা। চকরিয়ায় পিকআপ চাপায় ৫ ভাই নিহতের স্ত্রীরা এমন কথা প্রকাশ করেছেন। আর এক মা জানালেন, একজন সন্তান এখনো জীবন-মৃত্যুর কাছা-কাছি। ছোট্ট সন্তানটিও মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। তার চাওয়ার কিছুই নেই। যদি সরকার নিজের ইচ্ছেয় সু-দৃষ্টি দেন তবেই ঘুরতে পারে অসহায় পরিবার। জনপ্রতিনিধি আর প্রশাসন আশার কথা বলেছেন।
সরেজমিসে দেখা যায়, নীরব-কোলাহল মুক্ত একটি গলি। যে গলিতে অবস্থিত একটি পরিবারের ৫ ভাই নিহত হয়েছেন পিকআপ চাপায়। এ ঘটনায় নিহতের এক ভাই চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে লাইফ সার্পোটে রয়েছে। আহত এক বোনও চিকিৎসাধিন। সবার ছোট্ট ভাইটি এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন।
বাড়ির আঙ্গিনায় হতাশা আর অনিশ্চিত জীবনের চাপ নিয়ে বসেন আছেন নিহতের স্ত্রী। আশে-পাশে খেলা করতে দেখা যায় অবুঝ শিশুদের। যাদের অনেকেই এখনো জানে না তারা এখন পিতৃহারা। নিহতদের কেউ সেলুনের দোকান করতেন, কেউ করতে ফার্মেসিতে চাকুরি। একভাই বিদেশ ছিলেন দেশে এসেছিলেন পিতার মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতি পালনে। আগে থেকে পঙ্গু জীবন নিয়ে ভাইদের সহায়তা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকতেন একজন। পরিবারের আয়ের সকল মাধ্যম শেষ হলেও অনিশ্চিত জীবনে স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছেন স্ত্রী। নিহতের স্ত্রীরা কেবল বললেন, সন্তান নিয়ে কিভাবে জীবন যাপন করবেন জানেন না।
দীপক সুশীলের স্ত্রী পূজা সুশীল জানান, তাঁর স্বামী বিদেশ ছিলেন। তিনি দেশে এসেছে পিতার মৃত্যুর পর ধর্মীয় রীতি পালনে। কিন্তু আর বিদেশ ফেরা হল না। দিয়েছেন অনন্তকালের যাত্রা। ইচ্ছে ছিলো ছেলে সন্তানকে চিকিৎসক করবেন। কিন্তু এই স্বপ্নটা আর হয়তো বাস্তবে রূপ নেবে না। এখন নিজেই কিভাবে চলবেন এটাও অনিশ্চিত।
তিনি বলেন, “ কি করবো, ও (দীপক) তো চলে গেছে। এখন কি করার বা আছে?”
স্মরণ সুশীলের স্ত্রী কৃষ্ণা সুশীল জানান, তার এক ছেলে, এক মেয়ে। স্বামীর একটি সেনুলের দোকান ছিল। আর সেই সেনুলের আয় নিয়ে চলতো তাদের সংসার। কিন্তু আয়ের এক মাত্র অবলম্বন চলে যাওয়ায় দুই সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চিত ছাড়া কিছুই বলতে পারছেন তিনি।
নিরুপম সুশীলের স্ত্রী গীতা সুশীল জানান, তার সংসারে কোন সন্তান নেই। সন্তান হারা পরিবারে কাকে দেখা তিনি বেঁচে থাকবেন, জানেন না। অন্যদের সন্তান রয়েছে। হয়তো সন্তানের চেহেরা দেখে কিছু দুঃখ ভুলে থাকা যেত। কিন্তু তিনি এখন কি নিয়ে বেঁচে থাকবেন জানেন না।
তিনি জানান, নিরুপম একটা র্ফামেসীতে চাকুরি করতো। ওই আয়ে চলতো সংসার। এখন তিনি একা কোথায় যাবেন, কি করবেন বুঝতেও পারছেন না।
চম্পক সুশীলের স্ত্রী দেবিকা ঘোষ জানান, গত ৩ বছর আগে সড়ক র্দূঘটনায় স্বামী সহ আরেক ভাই আহত হয়েছিলেন। ওই সময় মারা যান এক ভাই। আর তার স্বামী হয়ে যান পঙ্গু। পঙ্গু জীবনে ভাইদের দেয়া সহায়তায় চলতো পরিবার। এখন ৫ ভাই একই সাথে মৃত্যু বরণ, এক ভাই হাসপাতালে চিকিৎসা। ছোট্টটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিছানায়। ফলে দেবিকাও বলতে পারছেন তার ভবিষ্যৎ জীবন-যাপনের কথা।
দেবিকা এখন ২ মেয়েকে নিয়ে চোখে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখছেন না।
প্রথমে স্বামীর মৃত্যু। এর দশ দিনে একই সাথে ৫ সন্তান হারানো মা মৃণালীনী বালা সুশীল কথা বলতে গিয়ে আটকে যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধিন ছেলে ও মেয়ের পাশা-পাশি ছোট্ট ছেলের ভারসাম্য হারানো নিয়ে চিন্তিত তিনি। এ মায়ের কোন দাবি নেই। তবে তিনি বিশ্বাস করেন সরকারের সু-দৃষ্টিতেই কেবল পরিবারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।
ডুল হাজারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর জানান, শুরুতে আহত বোনের চিকিৎসার দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। নিহতদের শশ্মান খরচও বহণ করেছেন। প্রশাসনিকভাবে কিছু সহায়তা দেয়া হয়েছে। নিহত-আহতদের পরিবারের নিজস্ব কোন জমি নেই। ফলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তিনি অনুরোধ করেছে হতাহত আট পরিবারকে আটটি মুজিব বর্ষের ঘর প্রদানের জন্য। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জমি দেখতে বলেছেন। জমি পেলে ইউনিয়নের পক্ষে ভরাট করে দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ জানান, ইতিমধ্যে প্রশাসন থেকে প্রথম পর্বে পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে মোট এক লাখ ২৫ হাজার টাকা ও খাদ্য দেয়া হয়। এরপর নগদ এক লাখ টাকা ও খাদ্য সামগ্রি দেয়া হয়। ভূমিহীন হিসেবে জমি বরাদ্ধ দিয়ে ঘর করে দেয়ার জন্য কাজ করবেন বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
প্রসঙ্গত, গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে সড়কের পূর্ব পাশে মৃত বাবার উদ্দ্যেশে পূজা দিয়ে বাড়ী ফিরতে একসঙ্গে রাস্তা পার হচ্ছিল ৯ ভাই-বোন। এসময় কক্সবাজারমুখি একটি পিকআপ তাদের ধাক্কা দিলে ৫ ভাই নিহত এবং ৩ ভাই-বোন আহত হন। এ ঘটনায় ওই রাতে নিহতদের ভাই প্লাবন সুশীল বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন রক্তিম সুশীল ও হীরা রাণী সুশীল। গ্রেপ্তার করা পিকআপ চালকের ৩ দিনের রিমান্ডও দিয়ে আদালত।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply