শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৫ অপরাহ্ন
বিডিনিউজ : অন্ধকার নামতেই রাখঢাক ছাড়াই অস্ত্র-মাদকের ব্যবহার গা সওয়া হয়ে গেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, খুনোখুনিও নতুন কিছু নয়; তবে নিজ কার্যালয়ে প্রত্যাবাসনে সোচ্চার মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ’র হত্যাকাণ্ড ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে সামনে এনেছে।
কক্সবাজারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর অপরাধের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানও সেদিকে ইঙ্গিত করছে।
জেলার দুর্গম সব এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক্যাম্পগুলোতে পারিবারিক সংঘাত থেকে শুরু করে ডাকাতি যেমন হয়, তেমনি অপহরণ, মানবপাচার, ধর্ষণ বা পুলিশের উপর হামলার মতো অপরাধের খবর হরহামেশাই আসছে। মামলাও হচ্ছে সংশ্লিষ্ট থানায়। অপরাধের তালিকায় মাদক ও অস্ত্রের আধিপত্য রয়ে গেছে আগের মতোই।
সোমবার ভোরেও উখিয়ার পালংখালীর বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অভিযান চালিয়ে ধারালো অস্ত্রসহ পাঁচজনকে আটক করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন।
রোহিঙ্গা নেতা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহ খুনের পর ক্যাম্পের বাসিন্দাদের অপরাধ প্রবণতা নিয়ে আবারও কথা হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ মহল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও।
তবে পুলিশ বলছে, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের জন্য প্রতিনিয়ত ক্যাম্পগুলোতে অভিযান চলছে। পুলিশি তৎপরতায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকই রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, “ক্যাম্পের সাধারণ বাসিন্দাদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো খেদ নেই।“
প্রত্যাবাসনে যত বেশি সময় লাগবে, ক্যাম্পের পরিস্থিতি তত খারাপ হবে মন্তব্য করে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে তৎপর সংস্থা আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়নের প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াকার উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তা জানে। তাই তারা তাদের বিলম্ব কৌশল অবলম্বন করে চলেছে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার পর ফিরে এসে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের চাপে যে পরিবেশ ও প্রতিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, সে কথা তিন জাতিসংঘেও তুলে ধরেছেন।
তবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকারকর্মী নূর খান ক্যাম্পে অপরাধের পরিসংখ্যানকে খুব বড় করে দেখার পক্ষপাতি নন।
“ছোট জায়গায় ১৩-১৪ মানুষের বসবাস, যাদের মধ্যে কিশোর ও যুবকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিছুটা হতে পারে,” বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া ক্যাম্পে নিজ কার্যালয়ে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ খুন হন। সন্ধ্যার পরপরই একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত খুব কাছে থেকে তাকে গুলি করে, মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর চলে যায়।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া নিয়ে শুরু থেকেই কাজ করছিলেন অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য এ সংগঠক। তার হত্যাকাণ্ড ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সামনে এনেছে।
চার বছরে ১ হাজার ৩৬৬ মামলা
কক্সবাজার জেলার ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে টেকনাফ থানা এলাকায় ১১টি ও উখিয়া থানা এলাকায় ২৩টি শিবিরের অবস্থান।
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার বছরে এ দুটি থানায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক হাজার ৩৬৬টি মামলা হয়েছে। এগুলোতে আসামি করা হয় ২ হাজার ৩৪৮ জনকে। যাদের মধ্যে এক হাজার ৭৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
জেলা পুলিশের হিসাব বলছে, মূলত ১০ ধরনের অপরাধে এসব মামলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ, অবৈধ অনুপ্রবেশ, অপহরণ, পুলিশের উপর হামলা, ডাকাতি ও ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা এবং মানবপাচার।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে মাদক মামলা, ৭০৬টি। ২০১৭ সালের পর থেকে ক্যাম্পগুলোতে মাদক অপরাধ বেড়েই চলেছে।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই বছরের শেষ চার মাসে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মাদক অপরাধে ২২টি মামলা হয়েছিল। গড় হিসেবে মাসে প্রায় ছয়টি করে মামলা। এরপর ২০১৮ সালে রোঙ্গিাদের বিরুদ্ধে ৯৫টি মাদক মামলা হয়। গড় হিসেবে মাসে প্রায় আটটি।
২০১৯ সালে মাদকের মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২টি; গড়ে মাসে প্রায় ১৩টি। ২০২০ সালে যা ছিল ২৫৬টি; গড়ে মাসে ২১ দশমিক ৩৩টি। চলতি বছরের আট মাসে (অগাস্ট পর্যন্ত) হয়েছে ১৮৪টি; গড়ে মাসে মামলার সংখ্যা ২৩টি।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো থেকে অস্ত্র উদ্ধার সংক্রান্ত মামলাও বেড়েছে বলে জানাচ্ছে পুলিশ।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে অস্ত্রের বিস্তার নিয়ে গত ৩ অক্টোবর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমার থেকে বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ অস্থির করার জন্য এখানে অস্ত্র আসছে। অস্ত্র নিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপের মারামারিও দেখেছেন।
পুলিশের হিসাব বলছে, ২০১৮ তে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ ও উখিয়া থানায় অস্ত্র মামলা হয়েছিল ১৩টি, পরের বছর তা বেড়ে হয় ১৭টি। ২০২০ সালে ২৭টি অস্ত্র মামলা হয়। চলতি বছরের নয় মাসে ১৩টি অস্ত্র মামলা হয়েছে।
ওই দুই থানা পুলিশের হিসাবে, ওই সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের হেফাজত থেকে ১৪টি দেশীয় পিস্তল, ৪৪টি এলজি, তিনটি বিদেশি পিস্তল, ৩০টি একনলা বন্দুক, ২৩টি দেশি বন্দুক, চারটি পাইপগানসহ প্রচুর পরিমাণে ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
সর্বশেষ চার বছরে ক্যাম্পগুলোতে সংঘাত আর হত্যার ঘটনাও কম নয়।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়া থানায় ৮৩ জন রোহিঙ্গাকে হত্যার অভিযোগে ৭৯টি মামলা হয়েছে। এর বাইরে এই দুই থানায় ২৪ জন রোহিঙ্গা বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
টেকনাফ ও উখিয়া ছাড়াও জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় বন্দুকযুদ্ধ শতাধিক রোহিঙ্গার মৃত্যুর কথা জানিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয় সাংবাদিকদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে মে মাসে দেশব্যাপী শুরু মাদকবিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ২৭৯ জন। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা ১০৯ জন। নিহত রোহিঙ্গাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন নারী।
গত ১ ও ২ অক্টোবর উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। মুহিবুল্লাহ খুন নিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে চাপা উত্তেজনা ছিল। এরমধ্যে অনেকেই সেভাবে কথা বলতে চাচ্ছিলেন না।
তবে আনসারউল্লাহ নামে এক তরুণ দোকানদার বলেন, রাতের বেলায় ক্যাম্পের ভেতর অস্ত্রধারী লোকজনের ঘোরাফেরা দেখে এখানকার বাসিন্দারা অভ্যস্ত। এই অস্ত্রধারীদের অনেকেই নিজেদের আরসার উপদল আল ইয়াকিনের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেয়।
আবার কিছু স্থানীয় দলও আছে উল্লেখ করে তিনি জানান, তারা ক্যাম্পের ভেতরে যারা ব্যবসা বা অন্য উপায়ে উপার্জন করে তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়।
ক্যাম্পের ভেতর ২০টির বেশি সংঘবদ্ধ দলের খবর জানিয়েছে পুলিশ। তবে সরকারের পক্ষ থেকে ক্যাম্পে আরসার উপস্থিতি বরাবরই অস্বীকার করা হচ্ছে।
পুলিশ কী বলছে
এসব বিষয় নিয়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম গত ৪ অক্টোবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ক্যাম্পগুলোতে পারিবারিক নির্যাতনের মামলা থেকে শুরু করে, ধর্ষণ, মাদক, অস্ত্র ইত্যাদি নানা অপরাধেই মামলা হচ্ছে।
“ক্যাম্পগুলোতে খুব ছোট্ট জায়গায় অনেক লোকের বসবাস। তাদের নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েও দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়। সেগুলোও আমাদের প্রচলিত আইনে মামলা হয়।“
পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা চলমান প্রক্রিয়া। এছাড়া ক্যাম্পগুলোর সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সেখানে সার্বক্ষণিক আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা মোতায়েন থাকেন।”
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, “রোহিঙ্গাদের অপরাধের পরিসংখ্যানের যে বিষয়টি প্রচার পাচ্ছে, তা এক ধরনের ‘ভিকটিম ব্লেইমিং’।
“মনে রাখতে হবে আমরা ইতিহাসের একটা পর্যায়ে মানবিকতার চূড়ান্ত নিদর্শন প্রদর্শন করেছি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে। এ বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের এটি মাথায় রাখতে হবে।”
নূর খানের ব্যখ্যা, রোহিঙ্গাদের অপরাধে যুক্ততার যে ধরনের পরিসংখ্যান বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আসছে তা থেকে বলা যায় অপরাধে যুক্ত মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
“আপনি যদি ১৩-১৪ লাখ মানুষের মধ্য থেকে অপরাধের হার (রেসিও) বের করেন তাহলে দেখবেন বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের চেয়ে খুব একটা বেশি হেরফের হচ্ছে না। একটা ছোট্ট জায়গায় এতগুলো মানুষের বসবাস। তাদের শিক্ষা, বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হচ্ছে কিশোর ও যুবা। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সংঘাত হতে পারে।“
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই এলাকার জন্য মাদকের ব্যবসা নতুন কিছু নয়। এমনকি জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসায় যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়। মাদক ব্যবসায়ীরা নানাভাবে রোহিঙ্গা ও রোহিঙ্গা শিবিরকে ব্যবহার করছেন।
“ছিনতাই, অপহরণ, মাদক এ ধরণের অপরাধের সঙ্গে স্থানীয় অপরাধীদের যোগসাজশ রয়েছে।“
তবে আরসা বা হারাকা আল ইয়াকিন, আরএসও, ইসলামী মাহাজ এই তিন সংগঠনের নামে এক ধরনের তৎপরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে উল্লেখ করে এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, “এর বাইরে মুন্না গ্রুপ, হাকিম ডাকাত বাহিনীর মতো কিছু অপরাধী দল আছে বলে শোনা যায়; যারা মাদক চোরাচালান, ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।“
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply