শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩১ পূর্বাহ্ন
বাংলা ট্রিবিউন: ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ সময় মিয়ানমার শাসন করেছে সামরিক বাহিনী। ১৯৬২ সালে নে উইন ক্ষমতা দখল করেন এবং ২০১১ পর্যন্ত শক্ত হাতে দেশ চালান। তবে আন্তর্জাতিক চাপে ধীরে ধীরে দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরত যাওয়ার একটি প্রয়াস দেখা যায়। তবে অং সান সু চির সঙ্গে বোঝাপড়ায় সামরিক বাহিনীর প্রভাব প্রায় অক্ষুণ্নই ছিল। যদিও গত বছরের নির্বাচনে সু চি’র দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লিগ (এনএলডি) সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সীমিত করার প্রস্তাব আনে।
২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং গত বছরের নভেম্বরের নির্বাচনেও একই ধরনের ফলাফল দেখা যায়। ভোটের এই ফল সামরিক বাহিনী মেনে নেয়নি। কারচুপির অজুহাত তুলে নির্বাচন বাতিলের দাবি জানায় তারা। ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণের আগে ক্ষমতা দখল করে নেয় সামরিক বাহিনী। এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা হ্রাসের শঙ্কা, সিনিয়র জেনারেল মিং আং হ্লাইং এর আগামী জুনে মেয়াদ শেষ হওয়া, যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলসহ আরও কিছু বিষয়কে।
তবে গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার জন্য মিয়ানমারে বিক্ষোভ চলছে এবং এই আন্দোলন বলতে গেলে এখন একটি কাঠামোগত শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এ পর্যন্ত বিক্ষোভে প্রায় আটশ নাগরিক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের একটি অংশ জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করেছে।
বিদেশি শক্তির প্রভাব ও হস্তক্ষেপকে বাদ দিলে মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ শক্তিগুলো একে অপরের সঙ্গে কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক আচরণ করছে সে বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমান। তিনি বলেন, মিয়ানমারে চলমান সমস্যা কোনদিকে যাবে এবং ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটি নির্ভর করবে মূলত এই শক্তিগুলো একে অপরকে কীভাবে প্রভাবিত করবে এবং এগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক কী ধরনের হবে তার ওপর।
সামরিক বাহিনী, বামার বা বার্মিজ সম্প্রদায়, বৌদ্ধ ধর্ম ভিত্তিক (উগ্র) ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং নৃতাত্বিক জাতিগোষ্ঠি- এই চারটি শক্তি স্থায়ীভাবে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে কাজ করে বলে জানান রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান।
সামরিক বাহিনী
মিয়ানমারে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হচ্ছে ওই দেশের সামরিক বাহিনী। প্রশাসন, সংসদ, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে ‘তাতমাদো’ নামে পরিচিত এই বাহিনী। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ রয়েছে। এই বাহিনীর সমর্থন ছাড়া সংবিধান সংশোধন করা অসম্ভব।
এছাড়া প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়ে থাকেন সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিরা। জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা কাউন্সিলে রয়েছে তাদের আধিপত্য। বামার জাতীয়তাবাদ ও উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠির সম্মিলন তাদের ক্ষমতাকে সংহত করেছে। এই বাহিনীর মূল সদস্যরা হচ্ছে বামার সম্প্রদায়ভুক্ত এবং মিয়ানমারে ৬৯ শতাংশ জনসংখ্যাই এই গোষ্ঠির।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পপর্কে সুফিউর বলেন, ‘মিয়ানমারে সবসময় ক্ষমতায় ছিল সংখ্যাগুরু বামার গোষ্ঠি। বর্তমানে বামার নিয়ন্ত্রিত সামরিক বাহিনী যাদের ওপর গুলি চালাচ্ছে তারাও সাধারণ বামার। দুই বা তিনটি সময় ও আন্দোলন ছাড়া এর আগে বামার শাসকরা সবসময়ে অন্য নৃতাত্বিক গোষ্ঠির ওপর গুলি ও অত্যাচার চালিয়েছে।’
সামরিক বাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ বিষয়টি ভালো বোধ করছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এর পরিমাণ বর্তমানে কম। কিন্তু ভবিষ্যতে এই বিক্ষোভ চলতে থাকলে এবং নির্বিচারে হত্যা হতে থাকলে অনেকের পক্ষ পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে। যা সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি করবে।’
বামার সম্প্রদায়
মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠি বামার সম্প্রদায়ভুক্ত। বার্মিজ নামেও পরিচিত তারা। এই গোষ্টির একটি অংশ সমর্থন করে সামরিক বাহিনীকে এবং বৃহৎ অংশটি অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
সাবেক রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান বলেন, ‘এই অংশটি জটিল। কারণ এই জনগোষ্ঠির একটি অংশ সামরিক বাহিনীর পক্ষে আছে এবং বাকিরা সমর্থন দিচ্ছে গণতান্ত্রিক শক্তিকে। এর মধ্যে একটি অংশ রাস্তায় বিক্ষোভ করছে এবং আরেকটি অংশ মৌনভাবে সমর্থন দিচ্ছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে এই জনগোষ্ঠির মধ্যে মূলত সুশীল সমাজ ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রজন্মের মধ্যে বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার বরাবরই বহির্বিশ্বের সঙ্গে কম যোগাযোগ রক্ষা করে চলতো। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে সামাজিক গণমাধ্যমের ব্যপক প্রসার হয়েছে এবং এর ফলে জনসংখ্যার একটি বড় অংশের সঠিক তথ্য জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
স্ট্যাটিস্টা ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২০১৬ সালে মিয়ানমারের মোট জনগোষ্টির ২০ শতাংশ সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করতো যা এখন ৫০ শতাংশেরও বেশি। ২০১৬-১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ফেসবুক ব্যবহার করে বামার ও বৌদ্ধদের অল্প সময়ের মধ্যে একত্রিত করা হয়। বর্তমানে সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।
সুফিউর মনে করেন, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। এই প্রবণতাকে পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াটা সামরিক বাহিনীর জন্য প্রায় অসাধ্য কাজ। এর ফলে বামার গোষ্টিকে নিজেদের পক্ষে রাখতে নতুন কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে সামরিক বাহিনীকে। অন্যথায় বামারদের সঙ্গে অন্যান্য নৃতাত্বিক গোষ্টির সমঝোতা সহজতর হবে।
উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠি
মিয়ানমারে ভিক্ষুরা বৌদ্ধ ধর্মের থেরাভেডা মতাদর্শ অনুসরণ করে। এই মতামর্শের অনুসারীরা থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে কিছুটা উগ্র আচরণ করে আসছে। ২০০৭ সালে স্যাফরন বিক্ষোভের সময়ে এই আদর্শের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা একযোগে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন। তবে বর্তমানে একটি বড় অংশ বর্তমানে সামরিক বাহিনীর পক্ষে।
এ বিষয়ে সুফিউর রহমান বলেন, এই গোষ্ঠি মিয়ানমারে বড় ধরনের প্রভাব রাখে। বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের সংখ্যালঘু একটি অংশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এবং সেটাও ক্ষীণ স্বরে। এর মাত্রা ভবিষ্যতে বৃদ্ধি পেলে সামরিক বাহিনীর জন্য বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে বলে মনে করেন রাষ্ট্রদূত সুফিউর।
নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি
মিয়ানমারে ১৩৫টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি সরকার স্বীকৃত এবং এদের মধ্যে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় নেই। স্বীকৃতি থাকুক বা না থাকুক সব সময়ে এদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়েছে বামার শাসক গোষ্ঠি। একটি ফেডারেল ব্যবস্থায় আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে কারেন, শান, কাচিন, আরাকানের বিভিন্ন বিছিন্নতাবাদী গ্রুপ সময়ে সময়ে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে।
সুফিউর বলেন, ‘বর্তমান ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এই ক্ষুদ্র গোষ্টির বড় অংশ আপাত গণতান্ত্রিক শক্তিকে সমর্থন দিচ্ছে তাদের অবস্থান শক্ত করতে এবং ফেডারেল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায়। এর ফলে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চল যেখানে এই গোষ্ঠিগুলো বসবাস করে, ওই জায়গাগুলো নতুন করে উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। এটি মিয়ানমারের সব প্রতিবেশীর জন্য সমস্যা বয়ে আনবে।’
ভবিষ্যৎ কী হতে পারে
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে সেটি এখনও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে এই সংকট যে দীর্ঘায়িত হবে এটি মোটামুটিভাবে বলা যায় বলে মনে করেন সুফিউর রহমান।
তিনি বলেন, ‘আভ্যন্তরীণ শক্তি এবং একই সঙ্গে বৈদেশিক চাপের ফলে কী পরিস্থিতি তৈরি হয় সেটি এখন পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’
একদিকে ভূ-রাজনীতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় দেশগুলো, আঞ্চলিক দেশসমূহ ও আসিয়ানের ভূমিকা কী হবে এবং এর বিরুদ্ধে বৃহৎ শক্তি চীন ও রাশিয়া কতক্ষণ মিয়ানমারকে আগলে রাখবে সেটির ওপরও নির্ভর করবে মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দেওয়া পাশ্চাত্য দেশগুলোর সঙ্গে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে জোর দেওয়া জাপান ও ভারতসহ অন্যান্য দেশের মধ্যে মতপার্থক্য কমলেই শুধু বৈদেশিক চাপ কার্যকর হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘একদিকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। অন্যদিকে মিয়ানমারের বর্তমানে সরকার নিজেদের সুসংহত করা চেষ্টা করবে। বৈদেশিক চাপের প্রভাবে অথবা নিজেদের দ্বন্দ্বে অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর অবস্থান পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করছে মিয়ানমারে ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে।’
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply