মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩১ অপরাহ্ন
বিডিনিউজ : এ দেশ যারা স্বাধীন করেছিলেন, ৫০ বছর পেরিয়ে এসে ক্রমশ কমে আসছে তাদের সংখ্যা; চেতনার পতাকা ধীরে ধীরে যাচ্ছে নতুন প্রজন্মের হাতে। সেই নতুন প্রজন্ম কোন পথে নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে?
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর সন্ধিক্ষণে উন্নয়নের পাশাপাশি নীতি-আদর্শের দিক থেকেও যাতে বাংলাদেশ ‘রোল মডেল’ হয়- সেই প্রত্যাশা করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুল হামিদ বলেছেন, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে- সেই বিশ্বাসই তিনি হৃদয়ে লালন করেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে যতবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, প্রতিবারই বিজয়ী হয়েছেন আবদুল হামিদ। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দুই বার জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
৭৮ বছর বয়সী হামিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলায় রিক্রুটিং ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। তখনকার সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীর সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ২০১৩ সালে আবদুল হামিদকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল আবদুল হামিদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন উপলক্ষে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা তুলে ধরেছেন। ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনী গঠন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। বলেছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে; নতুন প্রজন্মের কাছে তার আশা নিয়ে।
ফাইন্যানসিয়াল টাইমস বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছিল, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনও জন্ম নিত না’। বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য করার সুযোগ আছে কি?
এর উত্তর দিতে গেলে কিছুটা পিছনে যেতে হয়। কারণ আপনারা জানেন, পাকিস্তানের জন্য যখন মানুষ আন্দোলন করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুবর রহমানের অবদান ছিল। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানেও বঙ্গবন্ধুর একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে আন্দোলন শুরু হল। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। ৫৪ সালের নির্বাচন, ৫৮ সালের সামরিক শাসন, ৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪ সালে আইয়ুব খান-ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন, ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, ৬৯ সালে গণআন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচন- এই যে ধাপগুলি, প্রত্যেকটি ধাপে বঙ্গবন্ধু যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন, কোনো আপস তার মধ্যে ছিল না। এরমধ্যে উনি বহু বছর কারাবরণ করেছেন। জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেছেন। কিন্তু কোনোদিন বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে মাথা নত করেন নাই। ৭১ সালে সাতই মার্চের ভাষণে পাকিস্তানের সৃষ্টির পর থেকে বঙ্গবন্ধু জীবনে যে সংগ্রাম করেছেন তার একটা চিত্র, সেটা মাত্র ১৮ মিনিট কয়েক সেকেন্ডের বক্তৃতায় তুলে ধরেছিলেন। যখন উনাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নেওয়া হল, এমনকি পাকিস্তানের কারাগারে থাকাকালীন তাকে কবর দেয়া হবে, তার সেলের পাশে কবর পর্যন্ত করা হয়েছে। ঠিক নভেম্বরের মাঝামঝির দিকে বঙ্গবন্ধুকে জেলখানা থেকে ইয়াহিয়া খান নিয়ে গেলেন। সেখানে জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিল। আরও অনেক জেনারেল ছিল। যারা নাকি ভেবেছিল বঙ্গবন্ধু যে অবস্থার মধ্যে ছিলেন, হয়তো উনি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। হয়ত আপসের ব্যাপারে একটা সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া যখন তার দিকে হ্যান্ডশেইক করার জন্য হাত বাড়ালেন তখনই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘যে হাতে বাঙালির রক্ত লেগে আছে সে হাতের সাথে আমি হাত মেলাতে পারব না।’ এতে এটা মনে হয় যে, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো- এই কথাটা কোনো অবস্থাতে মেনে নেওয়া যায় না।
এটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আল্লাহপাকের ইচ্ছা, বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য, এ দেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য, বঙ্গবন্ধুর মত ব্যক্তিকে আল্লাহপাক সৃষ্টি করেছেন, যার মাধ্যমে আমরা এ দেশের স্বাধীনতা পেয়েছি।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আপনি ১৯৭০ এর নির্বাচনে অংশ নেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। সেই উত্তাল দিনগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে আমি তখন ঢাকায় ছিলাম। ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমনকি আমি নিজে নাখালপাড়ায় যে পার্লামেন্ট ছিল, সেখানে গিয়ে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি অব পাকিস্তানের মেম্বার হিসেবে আইডেনটিটি কার্ড নিয়েছি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৪-১৫ জন মেম্বার এখানে আসছিল অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য। স্যুট পরে অধিবেশনে যাব, সেটার ট্রায়াল দেওয়ার জন্য ১ তারিখ আসছিলাম। ট্রায়াল দিয়ে বের হওয়ার সময় দেখলাম শহরের মধ্যে হইচই লেগে গেছে। শুনলাম অধিবেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অনেক বক্তব্য রাখছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন বন্ধ করে দেওয়া হইছে। সারা ঢাকা শহরের চতুর্দিকে স্লোগান আর স্লোগান। আমি বায়তুল মোকাররমের ভিতর থেকে বের হয়ে যখন রাস্তার দিকে আসলাম সেখানে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায়। এমন কোনো রাস্তা, অলি-গলি বাদ ছিল না যেখানে জনগণ ছিল না। সেখানে লাঠিসোটা, হকিস্টিক, দা- যার যা অস্ত্র আছে, সশস্ত্র অবস্থায় মিছিলের পর মিছিল, সমানে মিছিল।
এর মধ্যে আবার খবর পাইলাম, ইমিডিয়েটলি জাতীয় পরিষদের সদস্যদের হোটলে পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু আহ্বান করেছেন সেখানে যাওয়ার জন্য। সেখানে উনি প্রেস কনফারেন্স ডাকছেন। রাস্তাঘাটে কোনো ধরনের যানবাহন ছিল না। যার জন্য আমি বায়তুল মোকাররম থেকে হাঁটতে হাঁটতে স্টেডিয়ামের ভিতর দিয়া হোটেল পূর্বাণীর কাছে গেলাম। তখন লোকে লোকারণ্য। ঢোকার কোনো জো নাই। তখন আমি আমার ওই যে আইডেন্টিটি কার্ড, ওটা দেখিয়ে বললাম যে, আমি জাতীয় পরিষদের সদস্য। এখানে আমাকে ডাকছে, আমাকে যেতে হবে। তখন জনগণই আমাকে রাস্তা করে সুযোগ করে দিল। সেখানে আমি উপস্থিত হলাম। আমাদের নেতৃবৃন্দ ছিল। জাতীয় পরিষদের সদস্য ৫০-৬০ এর মত ছিল, এর বেশি ছিল না।
সেখানে উনি (বঙ্গবন্ধু) বক্তব্য রাখলেন। বিভিন্ন ধরনের নির্দেশ দিলেন এবং পরে পারসন টু পারসন ডেকে বললেন, তুমি এই করো, সেই করো। শেষ পর্যন্ত আমাকেও ডাকল, ‘এই হামিদ এদিক আসো।’ আমি গেলাম। বললেন, ‘তুমি আজকের মধ্যে কিশোরগঞ্জ চলে যাবে। সব জায়গায় ছড়ায়া পড়তে হবে। আমাদের আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। চলে যাও। ঢাকা আর এক মুহূর্ত থাকা যাবে না।’ সেখান থেকে আমি এমএন হোস্টেলে গেলাম। একটা ব্যাগের মধ্যে কাপড়-চোপড় নিয়ে বের হলাম। তখন ছিল টিটাগাং মেইল। সেখানে উঠতে পারি নাই। ট্রেন ছাইড়া দিছে দরজাও খুলে নাই। ট্রেনের হ্যান্ডেল ধরে ঘোড়াশাল পর্যন্ত গেলাম। পরে একটা জানালা খুলছে। জানালা দিয়ে আমি ট্রেনের ভিতরে গেলাম। দুঃসহ অবস্থা! ঢাকার কমলাপুর থেকে ঘোড়াশাল পর্যন্ত এভাবে ধরে রাখা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। ভৈরবে নেমে সকালে ট্রেনে আমি কিশোরগঞ্জ গেলাম। কিশোরগঞ্জ গিয়া আমরা মিটিং-সিটিং করছি। আন্দোলন অর্গানাইজ করছি। তখনও আমাদের প্রস্তুতির ওইটা ছিল না, যুদ্ধ করব এমন ছিল না। কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম করব এই প্রস্তুতি ছিল।
সাতই মার্চের ভাষণটা যখন হলো, সবাই প্রতীক্ষা করছিলাম রেডিওতে ভাষণটা শুনব। রেডিওতে সম্প্রচারের কথা ছিল। কিন্তু ওইটা রেডিওতে সম্প্রচার করা হয় নাই। পরদিন সকালে বোধহয় ৯-১০টার দিকে ভাষণটা শোনালো। এই ভাষণ শোনার পর কিন্তু আমরা যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। আজিমউদ্দিন স্কুলের মাঠে ছাত্র-যুবকদের হাতে লাঠি দিয়ে ট্রেনিং দেওয়া শুরু হল। কামারের দোকানে বড় বড় রাম দা, তলোয়ার বানানোর অর্ডার দিছি। আমরা মনে করছি এইগুলি দিয়াই পাক আর্মি প্রতিহত করব। তাছাড়া আমরা বোতলের ভেতরে পেট্রোল ঢুকিয়ে সলতে লাগিয়ে, এগুলোকে মলোটভ ককটেল বলা হয়। এগুলোর মধ্যে আগুন লাগায় ঢিল মারলে বোমার মত কাজ হয়। এইগুলি আমরা হাজারখানেক বানাইছি। অর্থাৎ পাক আর্মি আসলে এদেরকে প্রতিহত করতে হবে।
ঠিক এ ধরনের একটা প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি। এরমধ্যে আমরা ১৭ মার্চ একটা তাৎক্ষণিক জনসভা ডাকলাম। সেখানে পাকিস্তানের পতাকা নামায়া পুড়ায়া দিলাম। বাংলাদেশের পতাকা উড়ালাম। আমি নিজেই কিশোরগঞ্জে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করছিলাম। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। যেহেতু আমি এমএনএ ছিলাম। আমার মনে হয় এমএনএ, এমপিএ বা আওয়ামী লীগের জেলার প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিদের কাছে বা মহকুমার প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিদের কাছে বোধহয় টেলিগ্রাম গেছিল। আমিও কিন্তু টেলিগ্রাম পাইছিলাম। ইংরেজিতে ছিল। মার্চ মাসের শেষ দিকে জেনারেল সফিউল্লাহ, তখন উনি মেজর ছিলেন। উনি ময়মনসিংহ হয়ে কিশোরগঞ্জ আসলেন। আমরা কনফিউজড ছিলাম। তারা পাক আর্মির পক্ষে নাকি, এই ব্যাপারে…পরে বুঝলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি হিসেবে চলে আসছে।
এটা জানার পর আমি নিজে সফিউল্লাহ সাহেবের সঙ্গে দেখা করছি, আমাদের আরও নেতৃবৃন্দ ছিল। পরে আমরা আজিমউদ্দিন স্কুলে উনাদের থাকার জন্য ক্যাম্প করে দিলাম। এদের বাজার-সদাই, চাল-ডাল যা লাগে মাছ-মাংস সব কিছু আমরাই সাপ্লাই দিছি। এপ্রিলের তিন-চার তারিখে সফিউল্লাহ সাহেব কোথায় যেন চলে গেল। কিন্তু এখানে এক প্লাটুন সৈন্য ছিল। তারা একসময় আমাদের ডাকল, বলল, কিশোরগঞ্জে যে কোনো সময় অ্যাটাক হতে পারে। মহকুমায় যে তিনটা ব্যাংক আছে, সেই ব্যাংকের টাকা যদি আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাখি তাহলে নিরাপদ রাখতে পারব। এই টাকা আমাদের দরকার হবে।
আমাদের মধ্যে একটু কনফিউশন তৈরি হলে। এইডা আবার কোন ঝামেলা হইল, টাকা নিয়া যাব। তখন তারাও বুঝতে পারল ব্যাপারটা। আমাদের সাথে যেতে বলল, কেউ যাইতে চাইল না। শেষ পর্যন্ত আমি আর আমার সঙ্গে একটা ছেলে সাগীর, তারে নিয়া আমিও গেলাম। এই তিন ব্যাংকের ১১ কোটি কয়েক লাখ টাকা আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়া জমা রাখছি। নয় এপ্রিল টাকা জমা রাখছি। যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবই ফল করল তখন সব টাকা আবার কিশোরগঞ্জ নিয়ে গেছিল। এক টাকাও এদিক-ওদিক হয়নি। টাকা জমা রাখার পর শুনলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমপিএ-এমএনএ সবাই আগরতলা গেছে। ১০ তারিখ ভাবলাম এদের সঙ্গে দেখা করি।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আপনি সরাসরি তাতে অংশ নেন। দেশের বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং প্রশিক্ষণসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
আমরা যে এতকিছু করছিলাম। আসলে হচ্ছেটা কি কিছুই জানতাম না। উই আর ইন ডার্ক। কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। তখন ভাবলাম আগরতলা গিয়ে যদি কিছু জানা যায়। যাওয়ার পর দেখলাম সেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েকজন আছেন, হবিগঞ্জের কয়েকজন আছেন। কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর কয়েকজন মিলে প্রায় ২৫-২৬ জন এমপি-এমএন পাইলাম। কলকাতায় তখন সরকার গঠনের আলাপ হচ্ছে। আগরতলা থেকে কলকাতায় যোগাযোগ হচ্ছে। আগরতলায় আলাপ আলোচনা হল। তাজউদ্দীন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি আর বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি- এই তিন ব্যাপারে আমরা একমত ছিলাম। যারা আগরতলায় ছিলাম তারা আরকি।
১৫ (এপ্রিল) তারিখ আমি আখাউড়া আসলাম। পাক আর্মির শেলিংয়ের ভিতর দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় রাত কাটাইয়া অষ্টগ্রাম গেলাম। অষ্টগ্রাম থেকে ১৯ তারিখ মিঠামইন গেলাম। যেসময় আমি বাড়ি পৌঁছলাম ওই সময় কিশোরগঞ্জে পাক আর্মি গেল। ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িতে ছিলাম। এলাকার লোক বলল আমি থাকলে আর্মি আসব। এরমধ্যে মিঠামইন এমনকি আমাদের বাড়িতেও শেলিং করছে। ৩১ মে আবার বাড়ি ছাড়লাম। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম বালাট (মেঘালয়)। সেখানে আস্তানা গাড়লাম।
ওখানে আমি ইয়ুথ রিসিপশন ক্যাম্প করলাম। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা যারা আসে তাদের রাখি। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। তাঁবুর ব্যবস্থা করে সেখানে রাখলাম। ট্রেনিংয়ে পাঠানো শুরু করলাম। রাজ্জাক সাহেব খবর দিলেন, উনি দেখা করবেন। আমি শিলং গেলাম, উনিও আসলেন। সঙ্গে সৈয়দ আহম্মদ সাহেব ছিলেন। আলাপ-আলোচনা করে বলল, এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। যারা মুক্তিযোদ্ধা আসছেন, যুদ্ধ ভিয়েতনামের মত অনেকদিন চলতে পারে। সুতরাং পলিটিকালি মোটিভেটেড যারা আছেন তাদের নিয়ে আলাদা বাহিনী করতে হবে। এটা গেরিলা টাইপের হবে। পরে এটা করা হল, বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ। সংক্ষেপে বলা হয় মুজিববাহিনী।
এই বিএলএফ গঠনের ব্যাপারে আলাপ হল। যারা ছাত্রলীগের লিডিং এবং পলিটিকালি মোটিভেটেড তাদের কিছু জাফলং, কিছু টাঙ্গুয়া পাঠালাম ট্রেনিংয়ের জন্য। রাজ্জাক সাহেব ছিলেন আমাদের সেক্টর কমান্ডার। আমি কিশোরগঞ্জ আর সুনামগঞ্জের সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলাম। পাশাপাশি ইয়ুথ রিসিপশনের চেয়ারম্যান ছিলাম। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা ট্রেনিংয়ে পাঠানো, এগুলো করছি। একইসাথে দুটাই আমি করছি। এক কোটির ওপর লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। যেখানে সীমান্ত সেখান দিয়েই মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা সরকারের সাথে কথা বলে সেখানে ছনের ঘর তৈরি করলাম। খাবারের তীব্র সঙ্কট ছিল। পরে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে রেশনের ব্যবস্থা করেছি। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, উনার সাথে আমরা প্রথম মেঘালয়েই দেখা। বালাটে উনি গেছিলেন।
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ করার খবর পাওয়ার পর অনুভূতি কেমন ছিল?
যুদ্ধ যখন প্রথম শুরু করি তখন মনে হইছিল আর বুঝি দেশে ফিরে যাইতে পারব না। পাহাড় থেকে বাংলাদেশের সমতল ভূমি দেখে চোখে পানি আইসা পড়ত, আবেগে পড়ে যেতাম। এই দেশে আর যাইতে পারব কিনা। যখন ভুটান স্বীকৃতি দিল, এরপর ভারত স্বীকৃতি দিল তখন মনে হল, একটা আলোর রশ্মি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পেয়ে যাব সেটা কল্পনারও বাইরে ছিল। স্বাধীনতা পাওয়ার পর যে অনভূতি সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। কী আনন্দ যে হয়েছিল, মনে হল পৃথিবীতে এর চেয়ে পাওয়ার আর কিছু হতে পারে না। আমরা স্বাধীন, আমরা মুক্ত। যে স্বাধীনতার জন্য আমরা এত কিছু করেছি, এত রক্ত, সংগ্রাম, আন্দোলন, জেল-জুলুম-নির্যাতন ভোগ করছি, সেই স্বাধীনতা আনতে পেরেছি। এর চেয়ে বড় কিছু পাওয়ার থাকতে পারে না।
স্বাধীনতা পরবর্তী পরিস্থিতি আর দেশ পুনর্গঠন?
আসলে ১০ তারিখ (১০ জানুয়ারি, ১৯৭২) আমিও ফিরে আসছি। আমার ফিরে আসায় দেরির কারণ ছিল। শরণার্থী যারা সেখানে ছিল তাদের দেশে ফেরত পাঠানো… অনেকেই দেশে আসতে ভয় পাচ্ছিল। বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সাথে মিটিং করছি। উত্সাহ দিছি। এসব কারণে আমার সময় লাগে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু একই দিনে ফিরে আসলেন। শরণার্থী যারা ছিল তাদের বাড়িঘর তো পুড়ায়া দিছেই, যারা দেশে ছিল তাদেরও, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ায়া দেওয়া হইছিল। সমস্ত কিছু পুনর্বাসন করা, দেশের ভিতরে যারা বিচ্ছিন্নভাবে ছিল তাদেরকে পুনর্বাসন করা একটা মহাযজ্ঞ।
তাছাড়া দেশের রাস্তা-ঘাট, পাক আর্মি যখন পরাজয় সুনিশ্চিত বুঝেছিল তারা অনেক কিছু ধ্বংস করে গেছে। রণকৌশলের জন্য আমরাও অনেক রাস্তা-ঘাট ধ্বংস করছি। ঠিক এ ধরনের একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের মধ্যে অবস্থান করে আমরা দেশকে পুনর্গঠন করার জন্য বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে যে যেখানে পারি সেভাবে কাজ করেছি। আমি কিশোরগঞ্জ মহকুমার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের সাহায্য করা, টিন দেওয়া, এমনকি ডেকচি-হাঁড়ি-পাতিল, হারিকেন থেকে আরম্ভ কইরা হেন কোনো জিনিস নাই, যেগুলো আমরা মানুষকে দেই নাই। রাস্তাঘাট করার জন্য কাজ করেছি।
আরেকটা কাজ ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র ছিল। অস্ত্র তাদের কাছ থেকে জমা নিছি। পাশাপশি কিছু অস্ত্র ছিল, রাজাকারদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিছে, যেগুলোর কোনো হিসাব ছিল না। এসব অস্ত্র বিভিন্ন জায়গায় চলে গিয়েছিল। সেগুলো সংগ্রহ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। যেহেতু আমি বিএলএফের সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলাম। তখনতো আর এখনকার মত জেলাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ছিল না। মুক্তিযোদ্ধা আর বিএলএফ সবকিছুর অস্ত্র আমি… ময়মনসিংহে তখন একজন এডিসি ছিল, সে আসলে সব অস্ত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। অস্ত্রগুলি সংগ্রহ করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হল। আপনি মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। যে প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সেই প্রত্যাশা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে কতটুকু পূরণ হয়েছে?
বঙ্গবন্ধুকে যদি ওই সময় হত্যা করা না হইত, তাহলে আরও ২০ বছর আগে আমরা এটা করতে পারতাম। এরপরেও আমি বলব, আজকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা অনেক এগিয়ে গিয়েছি। অনেক উন্নতি করতে পেরেছি।
বাংলাদেশ উন্নয়শীল দেশে উন্নীত হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকীর সন্ধিক্ষণে আপনি তরুণ প্রজন্মের কাছে কী প্রত্যাশা করেন।
যে আদর্শ, লক্ষ্য সামনে নিয়ে আমরা যুদ্ধ করছিলাম। দেশকে স্বাধীন করলাম। আজকে নতুন প্রজন্মকে এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখেই, আদর্শকে ধরেই তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেটাই আমার প্রত্যাশা। পাকিস্তান আমলে যাদের জন্ম হয়েছে তাদের সংখ্যা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। এমন একটা সময় আসবে, যারা দেশ পরিচালনা করবে, এদেশে থাকবে তাদের বাংলাদেশেই জন্ম।
সেই সময়ে বাংলাদেশ যেন সত্যিকারভাবে একটা আদর্শ দেশ হিসেবে, নাগরিকদের সততা, দেশপ্রেম এমন হবে যেন মানুষ দেশটাকে অন্যতম মডেল হিসেবে মনে করে। শুধু যে উন্নয়নের মডেলে যাচ্ছি তা না, আমাদের নৈতিক চরিত্র, আমাদের নীতি-আদর্শ এগুলো অন্য দেশের মানুষ যাতে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, ঠিক সেই পর্যায়ে নতুন প্রজন্ম দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেটাই আমি প্রত্যাশা করি।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply