শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩১ পূর্বাহ্ন
লোকমান হাকিম : ক্রিকেট, ফুটবলের বাইরে অন্য খেলাগুলোতেও আছে বড় তারকা। তিনি বাংলার আর্চারির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ‘রোমান সানা’। লাল-সবুজের জার্সিতে প্রথম আর্চার হিসেবে সরাসরি জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিকে।
করোনার কিছুটা স্বস্তি এনে দেয়ায় গত ১ থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত সমুদ্র শহরের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রোমান সানা এসেছিলেন তীর-ধনুক নিয়ে। প্রস্তুত হচ্ছেন জুলাইতে অনুষ্ঠিতব্য টোকিও অলিম্পিকের জন্য। দেশের হয়ে পদক জিতে লাল-সবুজের বাংলাকে নতুন করে তুলে ধরতে চান বিশ্বমঞ্চে। রোমানের প্রস্তুতি, সাফল্য এবং আর্চারিতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গল্পগুলো তুলে ধরেছেন প্রতিবেদকের কাছে।
রোমান : তখন আমি খুলনার শিশু মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন আমাদের হাসান স্যার বলেন, আর্চারি নামের একটি খেলা শুরু হয়েছে দেশে। এটার জন্য খেলোয়াড় বাছাই করতে ঢাকা থেকে কয়েকজন এসেছেন, তারা কয়েক দিন ট্রেনিং দেবেন তোমাদের। ভালো করলে ঢাকায় নিয়ে যাবে, উন্নত ট্রেনিং হবে, তারপর জাতীয় দলে খেলবে তোমরা। শুনে খুব একটা আগ্রহ জাগেনি। খেলার নাম আর্চারি, ক্রিকেট-ফুটবলের তুলনায় কিছুই না। তখন আমি ভালো ক্রিকেট খেলি। প্রথম দিন আর্চারির ট্রেনিংয়ে যাইনি, বকাঝকা করলেন হাসান স্যার। পরের দিন বাধ্য হয়ে ট্রেনিংয়ে অংশ নিলাম। সাজ্জাদ ভাই (সিনিয়র আর্চার) গিয়েছিলেন খেলা শেখাতে এবং ট্রায়াল নিতে। বাঁশের ধনুক, তার পেছনে সাইকেলের রাবারের টিউব বাঁধা। সেটা টেনেই ছুড়তে হয় তীর। একটু মজা লাগে, কারণ গুলতি দিয়ে পাখি শিকারের অভ্যাস আছে আমার। দুটোর মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়ায় আগ্রহ তৈরি হয় খানিকটা। তিন দিন ট্রেনিংয়ের পর ৪৫ জনের মধ্যে পাঁচজনকে মনোনীত করে, তার মধ্যে আমি একজন। মা-বাবাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঢাকা আসি এক মাসের ট্রেনিংয়ে। ওই সময় ১২টি জেলা থেকে ৪৩ জনকে বাছাই করে আনা হয়েছিল বিকেএসপিতে। সেখানে এক মাসের ট্রেনিং শেষে আমি হয়ে গেলাম প্রথম।
রোমান : ২০১০ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে। কিন্তু প্রথমে বাবা খেলার অনুমতি দেননি, আম্মা সবসময় অনেক সমর্থন দিতেন। বলতেন, এটাতে লেগে থাক। ইনশাআল্লাহ, ভালো কিছু হবে। এরপর ২০১৪ সালে ব্যাংককে এশিয়া কাপ স্টেজ ওয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, ২০১৭ সালে কিরগিজস্তানে আন্তর্জাতিক আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ জয়, ২০১৮ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক সলিডারিটি আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ ও বিকেএসপিতে দক্ষিণ এশিয়ান আর্চারিতে পদক পেয়েছি। এর বাইরে সবচেয়ে বড় সাফল্য ২০১৯ সালে। ফিলিপাইন, নেপাল ছাড়াও বিশেষ করে হল্যান্ডে বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালের ব্রোঞ্জ জয় করে পূরণ হয় সরাসরি অলিম্পিকে খেলার লক্ষ্য।
রোমান : ২০১৪ সালে। যখন আমি থাইল্যান্ডে ‘প্রথম এশিয়ান আর্চারি গ্রাঁ প্রিঁ’তে স্বর্ণ পদক জয় করি, তখন থেকে। ওই টুর্ণামেন্টে অলিম্পিকে পদক পাওয়া অনেক সিনিয়র আর্চারকে হারিয়েছিলাম।
রোমান: ভালো ক্রিকেট খেলতাম। তবে ওইভাবে চিন্তা ছিল না যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আসব। তখন বড় ভাইদের সঙ্গে খেলতাম পাড়াতে, ক্লাবে। সব জায়গায় খেলা হতো। কিন্তু ওইভাবে ক্রিকেট নিয়ে বড় চিন্তা করিনি। ক্রিকেটে গেলে হয়তো এত সফল হতাম না।
রোমান: সেরা তিনে দেখতে চাই। আর তার জন্য অল র্যাঙ্কিং টুর্ণামেন্টগুলো বেশি বেশি খেলতে হবে। যেমন, ওয়ার্ল্ড কাপের মতো ইভেন্ট খেললে র্যাঙ্কিংয়ে এগোনোর সুযোগ থাকে।
রোমান : আমারও স্বপ্ন যে আমি অলিম্পিকে একটা পদক অর্জন করব। দেশকে উপহার দেব। দেখেন, অলিম্পিক তো অনেক বড় একটা আসর। আর আমার জন্য এটা প্রথম। যেহেতু আমি প্রথমবারের মতো যাচ্ছি, এটা আমার কাছে একটু অবিশ্বাস্যই মনে হচ্ছে। আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি কিছু বলছি না। আমি চেষ্টা করব আরও কঠোর পরিশ্রম করতে।
রোমান : ঠিক বলেছেন, বড় আর্চার হওয়ার বড় মঞ্চ অলিম্পিক গেমস। এটার বিশালত্ব হলো, বিশ্বের সেরা অ্যাথলেটরা আসেন এখানে। এক হাজারেরও বেশি তীরন্দাজ থেকে বাছাই শেষে বিশ্বের ৬৪ জন লড়বে পদকের জন্য। এই গেমসের আকর্ষণ-আয়োজন, উপস্থিত দর্শকদের মুহুর্মুহু করতালি, পুরো পরিবেশটাই আলাদা। আমার মতো নতুন অলিম্পিয়ানকে নার্ভাস করে দেওয়ার সবই আছে সেখানে। তীর কতটা নিখুঁত হলো, সেটা দিয়ে পয়েন্টের বিচার হলেও এই খেলায় আসলে তীরন্দাজের শারীরিক ও মানসিক স্থিতির পরীক্ষা হয়। আমি ঠিকমতো নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম কি না, সেটারই পরীক্ষা। তাই অলিম্পিকে কথা দিতে পারব না। তবে আমার তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে স্বপ্নের মঞ্চে স্বপ্নপূরণের। আশা করছি, আমি একা না পারলেও আমার সতীর্থ যারা আছেন, সবাই মিলেও যেন বাংলাদেশকে একটা পদক এনে দিতে পারি।
রোমান : অলিম্পিকের আগে আরো ৫/৭টি টুর্ণামেন্ট আছে। কিছু টুর্ণামেন্টে ভালো হবে, আবার কিছুতে খারাপ হবে। সেখান থেকে ভুল শোধরে ভালোটা যাতে দিতে পারি সেটাই প্রত্যাশা করছি। এ জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
রোমান : দেখুন, এই টুর্ণামেন্টটা অলিম্পিককে ঘিরেই আয়োজন করা হয়েছে। কারণ, কক্সবাজারে কিন্তু বেশি বাতাস হয় বেশিরভাগ। আর্চারির আন্তর্জাতিক টুর্ণামেন্টগুলোও বেশির ভাগ বাতাসের মধ্যেই হয়। জাপানে টোকিওতে যেখানে আমাদের খেলা হবে সেই কন্ডিশন আর কক্সবাজারের কন্ডিশন প্রায় একই। সেই অভিজ্ঞতটা কাজে লাগানোর জন্য এই প্রতিযোগিতাটা আয়োজন করা। এটা থেকে আমার অনেক কিছুই অর্জন হয়েছে। ভুল ত্রুটি শোধরে সামনে বাংলাদেশ গেমসও কুয়াকাটা হওয়ার কথা রয়েছে সেটাও যদি হয় আমার জন্য অনেক ভালো হবে। তাছাড়া আরো কিছু অল সিরিজগুলো আছে যদি কন্টিনিউ সবগুলো খেলতে পারি আলহামদুলিল্লাহ একটা ভালো ফলাফল উপহার দিতে পারবো।
রোমান : আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহর অশেষ রহমত আছে বিধায় সকলের প্রচেষ্টায় এতদূর আসা। জানি না ক্রিকেটকে আমরা টপকাতে পারবো কিনা। তবে আমরা চাই, সাফল্যের দিকে দ্বিতীয় পজিশনে থাকতে। আমরা যদি পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারি আগামী ১০ বছর পরে অর্জনের দিক থেকে আর্চারি এক নম্বর খেলা হবে।
রোমান : সত্যি বলতে, আমার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদানটা আসলে তার। শুধু আমি নই, গোটা বাংলাদেশ আর্চারি দলের উন্নতি উনারই অবদান। কোচ হিসেবে যা যা গুণ থাকা দরকার, সবই রয়েছে তার ভেতরে।
রোমান : ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো। গরিব ঘরে জন্মে তিনি নিজের চেষ্টায় আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। তাঁর লড়াই এবং সেরা হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করাটা আমাকে খুব আন্দোলিত করে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া রোমান সানাও লড়াই করে এ পর্যন্ত এসেছে।
রোমান : সেটা আমি নিজে। আমার বিবেচনায় অন্য কেউ সেরা নয়। কারণ লড়াই করে, প্রতি পদে পদে নিজেকে প্রমাণ করে টোকিও অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছি। পাশাপাশি এই খেলাটিকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, এমন বৈশ্বিক সাফল্যের পরও কোনো কোনো মিডিয়ার ক্রীড়া পুরস্কারে আমি হয়তো বা বাদ হয়ে যাব ক্রিকেটারদের তোপে। দেশের বাইরে যতই সুনাম হোক, দেশে আমি ছোট খেলার এক খেলোয়াড়।
উল্লেখ্য, খুলনার প্রত্যন্ত অঞ্চল সুন্দরবন ঘেঁষা কয়রা উপজেলার বাগালি গ্রামের গুলতিবাজ এক কিশোর সময়ের পরিক্রমায় আজ এশিয়ার সেরা তীরন্দাজ। তাঁর বাবার নাম মো. আব্দুল গুফুর সানা ও মায়ের নাম বিউটি বেগম। তিন ভাই-বোনের মধ্যে রোমান সবার ছোট। রোমানের বড় ভাই বিপ্লব সানা।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply