শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩২ অপরাহ্ন
বাংলা ট্রিবিউন : মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের নিচ তলার মসজিদ সংলগ্ন ফটক। এই ফটক থেকে টাউন হল মার্কেটে প্রবেশের সময় মাথার ওপর ঝুলতে দেখা যায় নানা রঙয়ের ফেস মাস্ক। ফটকের মুখেই ১২/১৩ জন দর্জি সেলাই মেশিন নিয়ে কাজ করছেন। কেউ সেলাই মেশিনে পুরনো কাপড় সেলাইয়ে ব্যস্ত, কেউ কেউ আবার তৈরি করছেন ফেস মাস্ক। আবার কারো অলস সময় কাটছে পাশের জনের সঙ্গে গল্প করে। এটি শুক্রবার (২৪) সকাল সাড়ে ১১টার চিত্র।
টাউন হলে এই দর্জিদের মধ্যে একজন ওবায়দুল। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই মাস ধরে তিনি মাস্ক তৈরির কাজ করছেন। সেখানে তিনিসহ ছয় জন দর্জি ফেস মাস্ক তৈরি করছেন। স্বাভাবিক সময়ে এখানকার দর্জিরা মূলত পুরনো কাপড় সেলাই করেন। এছাড়াও নতুন পোশাক কিনে অনেক ক্রেতা তাদের কাছ থেকে ফিটিং করিয়ে নেন। তবে করোনা মহামারির সময় তাদের মূল কাজ নেই। তাই তাদের অনেকেই শুরু করেছেন মাস্ক তৈরির কাজ। এখন মাস্কের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় তাদের বেচা-বিক্রিও ভালো, লাভও বেশি। অর্ডারও আসছে শতশত।
কিন্তু এই মাস্ক মানুষকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাবে কিনা জানতে চাইলে ওবায়দুল বলেন, ‘কি বলেন, খুব ভালো, দুই লেয়ার গেঞ্জির কাপড়, দিয়ে বানাচ্ছি। করোনাতো দূরের কথা এই মাস্ক পড়লে মুখ-নাক দিয়ে কিছু ঢুকবে না।’
কীভাবে বুঝলেন করোনাভাইরাস ঢুকবে না, এই মাস্ক কি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ল্যাব থেকে মান পরীক্ষা করে দেখেছেন? এবার আর ওবায়দুলের জবাব নেই। একটু থেমে তিনি বলেন, ‘ওষুধের লোক কাপড়ের অনুমতি দেবে কেন?’
এরপর তাকে বলা হলো, মাস্ক একটি স্বাস্থ্যগত মেডিক্যাল আইটেম, এটি তৈরি ও বাজারজাতের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন নিতে হয়। তাদের নির্দিষ্ট ল্যাবে পরীক্ষার পর এসব সামগ্রী হওয়ার পর তৈরি ও বাজারজাতের অনুমোদন মেলে। এছাড়া এভাবে তৈরি ও বাজারজাত করা অবৈধ।
এ কথা শোনার পর ওবায়দুল এক বাক্যে বলেন, ‘আমি এত সব জানি না।’
ওবায়দুলের সামনেই জুয়েল নামে অপর এক দর্জি মাস্ক তৈরি ও বিক্রি করছেন। জুয়েল বলেন, ‘বিভিন্ন গার্মেন্টস থেকে তারা টুকরো গেঞ্জির কাপড় কিনে নিয়ে আসেন। এরপর টুকরো কাপড় দিয়ে ফেস মাস্ক তৈরি করেন। প্রতিটি ফেস মাস্ক তারা ৬০ টাকা থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি করেন।’ টাউন হল থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্ডার দিয়ে ৫০/১০০ করে মাস্ক কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ক্রেতারাও কোনোদিন জানতে চায়নি এইসব ফেস মাস্কের মান ঠিক আছে কিনা।
টাউন হলে ছয় জন দর্জিকে ফেস মাস্ক তৈরি করতে দেখা গেছে। যাদের কারও ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি নেই। এমনকি তারা কেউ জানেন না, মাস্ক তৈরির জন্য কোন কাপড় ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে প্যাকেজিং করতে হয়, কীভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হয়, মান রক্ষায় কী করতে হয়। তারা কেবল জানেন, ‘গেঞ্জির কাপড়’ দিয়ে মাস্ক বানালেই নিরাপদ!
টাউন হলে তিন ধরনের কাপড়ের ফেস মাস্ক দেখিয়েছেন দর্জিরা। তাদের ভাষায়, ‘একটি সুতি পাতলা কাপড়ের, একটি পভলিন কাপড় এবং একটি গেঞ্জির কাপড়ের।’ এরমধ্যে গেঞ্জির কাপড়ের মাস্কের দাম সর্বোচ্চ ৬০ টাকা, তবে এখন ৪০ টাকা করে বিক্রি করেন। বাকি দুই ধরনের মাস্ক ৩০ টাকা করে বিক্রি করছেন।
দর্জিদের এই মাস্ক তৈরির চিত্রি দেখা গেছে, নিউমার্কেট, মিরপুর, গুলিস্তান ও কেরানীগঞ্জ এলাকায়। কেরানীগঞ্জে ছোট ছোট কারখানায় এখন এই মাস্ক তৈরির চিত্র দেখা গেছে। কেউ আবার মাস্ক ব্যবসা দিয়েই প্রথম উদ্যোক্তা বনে গেছেন।
মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের নীচেও ফেস মাস্ক বানিয়ে বিক্রি করতে দেখা গেছে। রাসেল নামে এক দর্জি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মার্কেট খোলার পর থেকে ফেস মাস্ক তৈরি করে বিক্রি করছি। অন্য কাজ কম তাই।’
মাস্ক তৈরির ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে মান নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, সেটির আলোকে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করেছে। যেখানে কাপড়ের মান, কাপড়ের স্তর, ফেস মাস্কের শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণের প্রক্রিয়া, মাস্কের আদ্রতা শোষণের সামর্থ, কাপড় ক্ষতিকর রাসয়নিক মুক্ত হওয়া, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য মাস্ক হলে সেটি ডিটারজেন্ট বা সাবান দিয়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় মধ্যে ধুয়ে ব্যবহার যোগ্য কিনা তা নিশ্চিত করণ এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য কিনা তা বিবেচনা করতে হবে।
এছাড়া শিশু ও বয়স্কদের জন্য তৈরি মাস্কের ক্ষেত্রেও কিছু ভিন্ন নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। মাস্কের মান নিয়ন্ত্রণ ঠিক না থাকলে শ্বাস জনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। তবে এসব নির্দেশনা মানছে না বিভিন্ন এলাকায় মাস্ক তৈরির কারখানা।
ওষুধ প্রশাসনের কাছে দেশের কয়েকটি পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠান ফেস মাস্ক তৈরির অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিলো। এরপর গাউডলাইন অনুসারে সে সব প্রতিষ্ঠানের নমুনা মাস্ক ওষুধ প্রশাসনের ল্যাবে মান পরীক্ষা করা হয়। মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ওষুধ প্রশাসন তাদের মাস্ক তৈরির অনুমতি দিয়েছে বলে জানান উপ-পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে আরও বলেন, ‘আমরা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও পোশাক কারখানাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ফেস মাস্ক তৈরির অনুমতি দিয়েছি। তবে রাস্তাঘাটে গণহারে সবাইকে মাস্ক তৈরির কোনও অনুমতি দেওয়া হয়নি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাস্থ্যগত বিষয়, এর মান নিশ্চিত করেই এবং ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন নিয়ে বানাতে হবে। যদি কেউ অনুমতি বা অনুমোদন না নিয়ে তৈরি করে থাকে, তা অবৈধ। তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিতে পারে।’
আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘যারা ফেস মাস্ক তৈরি করতে চায়, তাদের অবশ্যই ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের থেকে অনুমোদন নিতে হবে। এরপর সবকিছু অনুসরণ করে ফেস মাস্ক প্রস্তুত করে আমাদের ল্যাবে পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বাজারজাত করার অনুমতি পাবে। আমাদের সাতটি ল্যাব রয়েছে, যে কেউ সেই ল্যাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাদের তৈরি মাস্কের মান যাচাই করতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ওয়েবসাইটে ফেস মাস্ক তৈরির গাইডলাইন দেওয়া রয়েছে। যারা ফেস মাস্ক তৈরি করতে চায়, সেটি অনুসরণ করতে পারেন। এরপর ওষুধ প্রশাসনের ল্যাব থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারেন।’
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার পর দেশে ফেস মাস্কের চাহিদা বেড়ে যায়। এক সময়ের কম দামের ফেস মাস্কের দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার জন্য নকল ফেস মাস্ক বিক্রি শুরু করেছে। অসাধু চক্রকে প্রতিরোধ করতে ওষুধ প্রশাসনের নেতৃত্বে র্যাব ও পুলিশ নিয়মিত মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে আসছে। ২৪ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে দুই হাজার ৮৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে দুই লাখ ১৮ হাজার ৬৫৮ জন এবং সুস্থ হয়েছেন এক লাখ ২০ হাজার ৯৭৬ জন।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply