শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫১ অপরাহ্ন
বিডিনিউজ : গত ১৮ জুলাই পুরান ঢাকার বংশাল ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩৫ লাখ টাকার জাল নোট এবং তা তৈরি বিভিন্ন উপকরণসহ তিন জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের করা মামলায় বলা হয়, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এই চক্রটি জাল নোট তৈরি করছিল। কোরবানির পশুর হাট, শপিংমল ও অন্যান্য জায়গায় এই জাল নোট ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল তাদের।
তার আগে ৩০ জুন মিরপুর ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি বাসা থেকে চার কোটি টাকার জালনোটসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। ওই জালনোটেরও লক্ষ্য ছিল কোরবানির হাট।
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশুর হাটগুলোতে নগদ লেনদেন বেশি হয়ে থাকে, যা আবার বড় অঙ্কের। আর এই সুযোগটি নিতেই জাল নোটের কারবারিরা এই সময়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
তাই ঈদের হাট বসার আগেই এসব ‘অসাধু কারবারীদের’ খুঁজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি পশু ব্যবসায়ী এবং সাধারণ জনগণকে নগদ লেনদেনে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিটি করপোরেশন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার পশুর অনলাইন হাটকে জনপ্রিয় করতে বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এবার ১৭টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১১টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ছয়টি হাট বসছে।
এছাড়া দুই সিটিতে আরও দুইটি স্থায়ী হাটেও পশু কেনাবেচা হবে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসছে পশুর হাট। যদিও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি এবার মহামারীর মধ্যে রাজধানীতে কোরবানির পশুর হাট না বসানোর সুপারিশ করেছিল।
এসব হাটকে কেন্দ্র করে এক দল অসাধু চক্র জাল টাকা ছড়াতে পারে এমন চিন্তা থেকে হাটগুলোতে টাকা গণনা ও জাল নোট সনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন করবে র্যাব ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থা।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাল নোটের কারবারিরা উৎসবকেন্দ্রিক সক্রিয় হয়ে যায়।
“আসন্ন কোরবানির হাটকে কেন্দ্র করে এই চক্রের সদস্যরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে আমাদের কয়েকটি সফল অভিযানে জাল নোট উদ্ধার এবং জাল নোট তৈরির যন্ত্রপাতি জব্দ করে বেশ কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
যে সব এলাকায় ফ্ল্যাটে বা বাড়িতে বসে জাল নোট তৈরি করে সেসব এলাকায় র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
“তারপরও হাটগুলোতে র্যাবের টহল থাকবে। হাটে জাল নোট চিহ্নিত করার যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হবে। এরপরও আমরা বলবো জনগণ যেন সচেতন হয়ে নগদ লেনদেন করেন।”
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান (ডিসি) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাল নোটের কারবারিরা এখন অনেক চালাক হয়ে গেছে।
“ঈদ আসলে এখন আর আগের মতো ঢাকার ভেতরে থাকে না। তারা ঢাকার বাইরে জাল নোট তৈরির কাজ করে, যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তাদের কাজ করতে পারে। তারা এখন ঢাকার বাইরে থেকে তাদের কাজ চালাতে তৎপর রয়েছে।”
“ঈদে জাল টাকার ছড়াছড়ির বেশি সুযোগ পায় বলে তারা ঢাকার বাইরে থেকে কাজ করে তাদের লোকদের নিয়ে টাকাগুলো বাজারে ছড়িয়ে দেয়,” বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
এসব বিষয় মাথায় নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশও সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশের যে অঞ্চলেই তারা কাজ করুক না কেন তাদের ধরতে আমরা সর্বদা প্রস্তুত আছি। আমাদের বিভিন্ন টিম এই বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে।”
থাকতে হবে সতর্ক
র্যাবের পরিচালক আশিক বিল্লাহ ও ডিবির ডিসি মশিউর দুজনই পশুর হাটে জাল টাকার কারবারিদের থেকে জনগণকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।
টাকা লেনদেনের সময় একটু বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সবাইকে অনুরোধ করেন তারা।
ঈদকেন্দ্রিক হাটগুলোতে জাল নোটের কারবারিদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে পদক্ষেপ নেওঢার কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে হাটগুলোতে জাল টাকা চিনতে সচেতনামূলক বেশ কিছু ক্যাম্পেইন করা হবে। পাশাপাশি হাটে হাটে বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতামূলক ব্যানার ও পোস্টার দেওয়া হবে। কীভাবে জাল টাকা শনাক্ত করা যায়, সেই বিষয়ে মানুষকে জানানো হচ্ছে।”
এছাড়া জাল নোট শনাক্তে হাটগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হবে জানিয়ে সিরাজুল বলেন, “হাটে হাটে আমাদের কর্মীরা কাজ করবে। আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মীদের দিয়ে এই কাজ করিয়ে থাকি। সেই ব্যবস্থা এবারও আমরা রাখছি।”
জাল নোট শনাক্ত করাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগের সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রাসেল সাবরিন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিটি হাটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মেশিন বসানো হবে, যাতে জাল টাকার ব্যবহার রোধ করা যায়। এই বিষয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা নিচ্ছি।”
জাল নোট যাতে হাটে ব্যবহার করতে না পারে সেই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের হাটগুলোতেও একই ব্যবস্থা থাকবে বলে জানান এই সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাটগুলোতে মেশিন থাকবে, তা দিয়ে টাকা গণনা করার জন্য পশুর কারবারিসহ সবাইকে আহ্বান জানাই। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন।”
জামিনে বেরিয়ে ফের একই কাজে
মুদ্রা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতরা সেই কাজে বেশ ‘অভিজ্ঞ’ এবং তারা গ্রেপ্তার হলে আইনের ফাঁক-ফোকরে জামিন নিয়ে বেরিয়ে একই কাজে ফের সম্পৃক্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
র্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, “তাদের স্বপ্ন রাতারাতি বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক হওয়া। তারা আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে পুনরায় একই কাজের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
“আমরা লাস্ট যাদেরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি, তাদের বেলায় একই ঘটনা দেখেছি। এর আগেও তারা বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। জামিনে বের হয়ে আবার একই কাজে সম্পৃক্ত হয়েছে।”
আশিকের মতো তথ্য পাওয়া যায় গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি মশিউরের কাছেও।
তিনি বলেন, “এখন যাদের আমরা গ্রেপ্তার করছি, তাদের অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে আগেও বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়েছে, তারপর জামিনে রেবিয়ে তারা পুনরায় একই কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে যারা এখন জামিনে আছে তাদেরকে আমরা একটু বেশি নজরদারিতে রেখেছি।”
মুদ্রা জাল করার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশই জামিন বেরিয়ে আসছে বা তাদের বিচার না হওয়া সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম।
জাল মুদ্রার কারবারীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা হলেও অপরাধীদের অধিকাংশই খালাস পেয়ে যায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিশেষ ক্ষমতা আইনের এবং দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারায় জাল নোট তৈরি, সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয়সহ সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে থাকে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়, কারণ সাক্ষীর অভাব।
“যে এলাকা থেকে জাল নোটের কারবারিকে ধরা হলো সেই এলাকায় স্থানীয় কাউকে সাক্ষী করা হল। সেই সাক্ষী দুই-একবার আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসার পর পরবর্তীতে আর আসেন না। তো দেখা গেল সাক্ষীর অভাবে আসামি খালাস পেয়ে গেল।”
আসছে নতুন আইন
মুদ্রা জালকরণ, প্রস্তুত, ক্রয়-বিক্রয়সহ সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন ও দণ্ডবিধি কয়েকটি ধারায় মামলা করা হলেও পুরোনো আইনের ‘দুর্বল ধারার’ কারণে অপরাধীরা বেরিয়ে যায় বলে এই বিষয়ে নতুন একটি আইনে দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে।
এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া মতামতের গ্রহণের জন্য গত ৯ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েব সাইটে দেওয়া হয়েছে।
‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন- ২০২০’ খসড়ায় মুদ্রা জালকরণ, ক্রয়-বিক্রয়সহ ১৪ ধরনের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ততার দায়ে সর্বনিম্ন দুই বছর কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, পুরাতন আইনে জাল মুদ্রার কারবারি ও সংশ্লিষ্টদের বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় আসামিরা।
“এখন নতুন যে আইন হচ্ছে সেই আইনে বিচারের পদ্ধতি যেন সহজ হয়। তিন মাসের মধ্যে এইসব অপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে পারলে অপরাধীরা সাজা পাবে এবং এই অপরাধ কমে আসবে।”
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply