বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৮ অপরাহ্ন
যুগোস্লাভিয়া—আজকের প্রজন্মের অনেকে হয়তোবা সেভাবে এ নামটি শোনেনি। তবে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত যুগোস্লাভিয়া একটি প্রতিপত্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিল। ইউরোপ তো বটেই এমনকি বিশ্বরাজনীতিতে দেশটি ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী রাষ্ট্র। কালের গর্ভে যুগোস্লাভিয়া শব্দটি এখন অনেকটা মুছে গেছে মানুষের মন থেকে, আজ যুগোস্লাভিয়া কেবল একটি ইতিহাস।
মূলত যুগোস্লাভিয়া ছিল ছয়টি ভিন্ন রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি ফেডারেশন। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সার্বিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া এবং মন্টেনিগ্রো সমন্বিতভাবে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন গঠন করে। প্রথম দিকে ফেডারেশন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধের সময়ে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যসহ অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, গ্রিস ও বুলগেরিয়ার আক্রমণ থেকে দেশগুলোকে প্রতিহত করা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সার্বিয়ার দখল করা আলবেনিয়া অংশটি ‘কসোভো’ নামে বিশ্ব মানচিত্রে পরিচিতি লাভ করে। কসোভো সে সময় সার্বিয়ার অংশ ছিল। যুগোস্লাভিয়ার শাসনব্যবস্থা ছিল অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের মতো। যুক্তরাষ্ট্র যেমনিভাবে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সমন্বয়ে গঠিত। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব সরকার রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের প্রত্যেকের নিজ নিজ সরকার ছিল। ফেডারেশনের প্রতিটি সরকার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখত, তবে শর্ত ছিল কোনো আইন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রণয়ন করা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের রাজধানী ছিল বেলগ্রেডে। বেলগ্রেড বর্তমানে সার্বিয়ার রাজধানী। ইউরোপের অন্যতম প্রধান দুটি নদী দানিউব ও সাভার সমঙ্গস্থল ছিল বেলগ্রেড। বেলগ্রেড ছিল সে সময় পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে প্রধান সেতুবন্ধের নগরী। আর এ কারণে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যসহ ইউরোপের সব পরাশক্তিধর সাম্রাজ্যগুলোর নয়নের মণি হয়ে উঠেছিল বেলগ্রেড।
বেলগ্রেড ছিল তদানীন্তন ইউরোপের সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী নগরীর মধ্যে একটি এবং এ শহরটি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল। আয়তন ও জনসংখ্যা—দুই বিবেচনায় এ শহরটি ছিল যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের সবচেয়ে বড় শহর। অন্যদিকে লুবলিয়ানা, জাগরেব, স্কোপিয়ে, পোডগোরিছা, সারায়েভো শহরগুলো তখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। যদিও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে এদের অনেকে প্রাদেশিক রাজধানীর ভূমিকা পালন করেছে। যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রভাষা ছিল সার্বো-ক্রোয়েশিয়ান। সার্বিয়ান ও ক্রোয়েশিয়ান—দুটি ভাষা সম্মিলিতভাবে সার্বো-ক্রোয়েশিয়ান নামে পরিচিত। তবে স্লোভেনিয়ান, বসনিয়ান, মন্টেনেগ্রিন, আলবেনিয়ান, মেসিডোনিয়ান এসব ভাষারও প্রচলন ছিল যুগোস্লাভিয়ায়। সার্বিয়ান, ক্রোয়েশিয়ান, স্লোভেনিয়ান, মন্টেনিগ্রেন, বসনিয়ান, মেসিডোনিয়ান—এ ছয়টি ভাষা সাউদার্ন স্লাভিক ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে পরিচিত এবং ছয়টি ভাষা অনেকটা কাছাকাছি ধাঁচের। অন্যদিকে আলবেনিয়ান ভাষাটি সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন একটি ভাষা। ইউরোপের কোনো ভাষার সঙ্গে এ ভাষার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকের মতে, আলবেনীয়রা প্রাচীন ইলিরিয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের বংশধর, যাদের নিবাস ছিল অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলে।
সাংবিধানিকভাবে যুগোস্লাভিয়া ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেও বরাবর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবমুক্ত। যুগোস্লাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক কাঠামো সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো তেমন রক্ষণশীল ছিল না। যুগোস্লাভিয়া মুক্তবাজার অর্থনীতি পুরোপুরিভাবে অগ্রাহ্য করেনি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, কানাডা—সব পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সখ্য ছিল। এমনকি যুগোস্লাভিয়ার নাগরিকদের কোনো বিধিনিষেধ ছিল না পশ্চিমা দেশগুলোতে ভ্রমণের ব্যাপারে। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার পরও পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রতি তারা যেমন উদার ছিল; অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আদর্শিকভাবে তারা মিশে থাকতে পেরেছিল। যদিও মার্শাল টিটো যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোকে স্টালিনের প্রভাব থেকে অনেকখানি দূরে রেখেছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে যুগোস্লাভিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল বাজার অর্থনীতি এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা এ দুইয়ের মাঝামাঝি। রাজনৈতিকভাবে পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম ইউরোপের তথা ‘Eastern Europe’ আর ‘Western Europe’–এর মধ্যে বিভাজন টানা হয় নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে। গ্রিস ভৌগোলিকভাবে পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত হলেও গ্রিসকে খুব একটা পূর্ব ইউরোপীয় দেশ বা ‘Eastern European Country’ বলা হয় না কেননা দেশটিতে কোনো সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা কমিউনিজমভিত্তিক শাসনব্যবস্থার কোনো প্রভাব ছিল না।
রাষ্ট্র প্রতি পরিবারকে একটি বাড়ি ও একটি গাড়ি দিত
আলিয়োসা,
বর্তমানে বয়স ষাটের কাছাকাছি। স্লোভেনিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নোভা গোরিছার
অধিবাসী। পেশায় ছিলেন একজন ফ্যাক্টরি ম্যানেজার। আমাদের হোস্টেল থেকে কয়েক
গজ দূরে ‘কেলটিবার’ নামে একটি কফি বার আছে। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা।
মাঝেমধ্যে বিকেলে সময় কাঁটাতে সেখানে আসেন। কেমন ছিল যুগোস্লাভিয়ার
দিনগুলো—এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, যুগোস্লাভিয়ায় সে সময় যাবতীয় সম্পদ
ছিল রাষ্ট্রমালিকানাধীন। ব্যক্তিমালিকানাধীন বলে কোনো কিছু ছিল না। তবে
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি বাড়ির এবং একটি গাড়ি
বরাদ্দ দেওয়া হতো। পাশাপাশি স্বাস্থ্য, চিকিৎসাসহ যাবতীয় মৌলিক অধিকারগুলো
সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য ছিল। বিশেষ করে সে সময় সবচেয়ে বেশি লাভবান ছিল
শ্রমিকশ্রেণির মানুষ। কাজের পাশপাশি তাদের অবকাশযাপনের জন্য সপরিবার
সমুদ্রসৈকতে পাঠানো হতো এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের এ জন্য অনুদানও
দেওয়া হতো। আলিয়োসার মতে সে সময় হয়তোবা মানুষের আয় আজকের দিনের মতো এতটা
উচ্চ ছিল না, কিন্তু জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের মতো সামর্থ্য সবার ছিল,
যেটি আজকের দিনে স্লোভেনিয়ার অনেক মানুষের নেই।
বিশ্বমানচিত্রে যুগোস্লাভিয়া। ছবি: সংগৃহীত২০০৭ সালে স্লোভেনিয়া ইউরো জোনে প্রবেশ করে। আলিয়াসোর মতে, ইউরো জোনে প্রবেশ করার ফলে স্লোভেনিয়াতে জীবনযাত্রার ব্যয় আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু সে অনুপাতে মানুষের আয় তেমন বাড়েনি। গড়ে প্রতিটি জিনিসের দাম দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে। ইউরো জোনে প্রবেশের আগে এক কাপ কফির দাম ছিল ৪০ সেন্ট, ইউরো জোনে প্রবেশের মাসের ব্যবধানে সেই কফির দাম বেড়ে হয় ১ ইউরো। আলিয়োসা জানান, যদিও যুগোস্লাভিয়া ছিল কমিউনিজমের ভাবাদর্শে গড়া রাষ্ট্র তবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে সে সময় কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছিল না। প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারতেন। রাষ্ট্র ছিল সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত। আলিয়াসো বলেন, সে সময় যুগোস্লাভিয়ার মানুষ ক্যাথলিক খ্রিষ্টান, অর্থোডক্স খ্রিষ্টান এবং ইসলাম—তিনটি প্রধান ধর্মের অনুসারী ছিল। স্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ছিল ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। অন্যদিকে সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া এবং মন্টেনিগ্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অর্থোডক্স খ্রিষ্টান এবং বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ও কসোভোর বেশির ভাগ মানুষের ধর্ম ছিল ইসলাম। আলিয়াসোর মতে, সে সময় মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি ছিল চোখে পড়ার মতো কিন্তু স্বাধীনতা–পরবর্তী স্লোভেনিয়ায় সে সম্প্রীতি অনেকটা কমে এসেছে বলে তিনি জানান। আলিয়োসোর জীবনের সেরা সময় ছিল যুগোস্লাভিয়া যুগে ফেলে আসা রঙিন দিনগুলো।
একই সঙ্গে বেশ কিছু কারণে আলিয়াসো দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, অভিন্ন ফেডারেশনের অংশ হওয়া সত্ত্বেও যুগোস্লাভিয়ার বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে জীবনযাত্রার মানেও ব্যাপক তারতম্য ছিল। আলিয়াসো বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার স্লোভেনিয়া ছিল ফেডারেশনভুক্ত অন্য দেশগুলোর থেকে অনেক এগিয়ে। তবে মার্শাল টিটোর দূরদর্শিতার কারণে শেষ পর্যন্ত তারা একতাবদ্ধ হয়ে একই রাষ্ট্রের ছায়াতলে ছিলেন। মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এ ঐক্যে ভাটা পড়ে, যুগোস্লাভিয়ায় চিড় ধরে ঐক্য এবং ভেঙে কতগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
কমিউনিস্ট নেতারা আজ ডানপন্থী রাজনীতিবিদ হয়েছেন
ইয়োজে নাল, বর্তমানে
একটি মোটরগাড়ি কোম্পানির আর্টিফিসিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। স্লোভেনিয়ায়
পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পরিষেবা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি, তাই এখানে বেশির ভাগ
মানুষ বলতে গেলে নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করেন। স্লোভেনিয়ার অভ্যন্তরে
‘প্রেভোজি’ নামে রাইড শেয়ারিং সার্ভিস রয়েছে। মনে করেন, আপনি রাজধানী
লুবলিয়ানা থেকে কোথাও যাচ্ছেন নিজের গাড়ি চেপে। এ সময় চাইলে আপনি কাউকে
রাইড অফার করতে পারেন যদি তারও সেখানে বা তার আশপাশের কোনো জায়গায় যাওয়ার
প্রয়োজন হয়।
জানুয়ারিতে আমি লুবলিয়ানা থেকে ইতালির ত্রিয়েস্তে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। এ জন্য কার রাইড শেয়ারিং পরিষেবা প্রেভোজির শরণাপন্ন হই। এভাবে ইয়োজের সঙ্গে পরিচয় হয়। ইয়োজে খুবই প্রাণখোলা মানুষ। কথা প্রসঙ্গে তার কাছে যুগোস্লাভিয়া সম্পর্কে জানতে চাই। ইয়োজে জানান, ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্লোভেনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্রের যাত্রার সময় তিনি কেবল যৌবনে পা দিয়েছেন। তিনি মূলত স্লোভেনিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর ম্যাটলিকার অধিবাসী।
ইয়োজের মতে যুগোস্লাভিয়ার দিনগুলো স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষের জন্য সে সময় সুখকর ছিল না। যদিও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সব নাগরিক সুবিধার বন্দোবস্ত ছিল। কিন্তু সে সময় কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না। মার্শাল টিটোকে তিনি স্বৈরাচারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। যেহেতু যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সব সম্পদ রাষ্ট্রমালিকানাধীন তাই আমলাতন্ত্র সে সময় শিকড় গেড়ে বসেছিল। বাইরের দেশগুলো থেকে বিভিন্ন খাতে যেসব ঋণ আসত, তার বৃহৎ অংশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নিজেদের পকেটে পুরতেন। এ জন্য দেখা যায় যুগোস্লাভিয়ার পতনের পর স্লোভেনিয়াসহ অন্য দেশগুলোতে সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি তাঁরাই যাঁরা কমিউনিস্ট সরকারের সবচেয়ে আস্থাভাজন ছিলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো সস্তা মূল্যে তারা নিজেদের নামে কিনে নিতে পেরেছিলেন। ইয়োজের মতে, পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়া, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার সাবেক কমিউনিস্ট নেতারা সবচেয়ে ধনী। এদের অনেকে আজ অতি ডানপন্থী রাজনীতিবিদ হয়েছেন।
আলিয়োসার মতো ইয়োজেও যুগোস্লাভিয়ার পতনের কারণ হিসেবে মার্শাল টিটোর মৃত্যু–পরবর্তী নেতৃত্বের সংকটকে দায়ী করেন। ইয়োজে জানান টিটো–পরবর্তী যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের প্রত্যেকের দাবি ছিল তাদের নিজেদের অংশ থেকে কাউকে যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান করা হোক। সার্ব ও ক্রোয়াটদের বেশ কিছু একগুঁয়েমি মনোভাব এ ক্ষেত্রে যুগোস্লাভিয়ার পতনকে ত্বরান্বিত করে। সার্বিয়ার বিরুদ্ধে সব সময় অভিযোগ ছিল রাজধানী বেলগ্রেড তাদের সীমানাভুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রীয় আয়ের বড় অংশ তারা কুক্ষিগত করে রাখত এবং অন্যদের তারা তাদের আয়ের প্রাপ্ত অংশ দিতে গড়িমসি করত। অন্যদের ওপর তারা প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করত। ১৯৮৯ সালে স্লোবোদান মিলোসেভিচ যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব সার্বিয়ার সঙ্গে ফেডারেশনভুক্ত অন্য দেশগুলোর দূরত্ব বাড়ায়। ফেডারেশনভুক্ত অন্য দেশের নাগরিকদের ধারণা হতে থাকে মিলোসেভিচ কার্যত যুগোস্লাভিয়াকে সার্বিয়ার উপনিবেশে পরিণত করতে চলেছেন।
১৯৯১ সালের ২৫ জুন স্লোভেনিয়া প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। কিন্তু সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়া স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতার দাবিকে অস্বীকার করে। শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধ, যা ১০ দিন স্থায়ী ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি ছিল ইউরোপের ইতিহাসে প্রথম কোনো যুদ্ধ, যা ১০ দিন স্থায়ী হয়েছিল। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে স্লোভেনিয়ার পক্ষে সহজে স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়। স্লোভেনিয়ার দেখাদেখি ক্রোয়েশিয়াও স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে স্লোভেনিয়াকে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া দেশটির নাম ক্রোয়েশিয়া এবং একই সঙ্গে ক্রোয়েশিয়াকেও প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়া দেশটির নাম স্লোভেনিয়া। সার্বিয়া একে একে ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ও কসোভোকে আক্রমণ করে বসে এবং তাদের ওপর নৃশংস গণহত্যা চালায়। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা এবং কসোভো অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ায় তাদের ওপর বিভীষিকা নেমে আসে। শুরু হয় যুগোস্লাভ যুদ্ধ, যা তৃতীয় বলকান যুদ্ধ নামেও পরিচিত। একটা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কতটা উগ্র হতে পারে সার্বিয়ানরা তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। যেকোনো আন্তর্জাতিক সূচকে সার্বিয়া ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক খারাপ অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপের মধ্যে সার্বিয়া বলতে গেলে সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ ও অপরাধপ্রবণ জাতি। গোটা ইউরোপে বলতে গেলে সার্বিয়ানরা এ জন্য অনেকটা একঘরে। তবে এখনো সার্বিয়ানরা নিজেদের ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে পরিচয় দেয়।
সেব্রেনেছা গণহত্যার কথা আমরা অনেকে শুনেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বিভীষিকাময় গণহত্যা হিসেবে পরিচিত যেখানে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিন বছর বিদ্রোহী সার্ব মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞের শিকার হন কয়েক হাজার নিরীহ বসনিয়ান নাগরিক।
গণভোটে ১৯৯২ সালে মেসিডোনিয়া যুগোস্লাভিয়ার জোট থেকে আলাদা হয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করে। মন্টেনিগ্রো শেষ পর্যন্ত সার্বিয়ার সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে থেকে গেলেও ২০০৬ সালে মন্টেনিগ্রো সার্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হয়।
২০০৮ সালে সার্বিয়ার অধিকৃত আলবেনীয় অংশের অধিবাসীরা স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। নতুন রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয় কসোভো। সার্বিয়া এখনো কসোভোকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে এবং কসোভোর এ স্বাধীনতা দাবিকে অস্বীকার করে। কসোভো নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে, কেননা কসোভো এখনো সর্বতোভাবে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি।
বিশ্বমানচিত্র থেকে এভাবে চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া। যুগোস্লাভিয়া পতনের কারণ হিসেবে স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা এবং কসোভোর বেশির ভাগ অধিবাসী এককভাবে সার্বিয়ানদের দায়ী করেন।
যুগোস্লাভিয়া গঠনের নেতৃত্বে ছিল সার্বিয়া, মূলত দক্ষিণীয় স্লাভিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে অভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে যুগোস্লাভিয়া গঠন করার কথা বলা হলেও এর পেছনে সার্বিয়ানদের উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা নিহিত ছিল। বুলগেরিয়ানরা যদিও জাতিগতভাবে দক্ষিণীয় স্লাভিক জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত কিন্তু মেসিডোনিয়ার দাবি নিয়ে তাদের সঙ্গে সব সময় সার্বিয়ানদের দূরত্ব ছিল। এ কারণে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন গঠিত হলে বুলগেরিয়া সেখানে যোগ দেয়নি। মেসিডোনিয়ার উত্তরাধিকার নিয়ে গ্রিস, বুলগেরিয়া এবং সার্বিয়ার মধ্যে সব সময় বিবাদ চলে আসছিল, এমনকি এদের মধ্যে যুদ্ধও হয়েছিল। যদিও স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত সব দেশ তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। বুলগেরিয়ার দাবি হচ্ছে মেসিডোনিয়া একসময় তাদের অংশ ছিল এবং এর প্রমাণ হিসেবে তারা মেসিডোনিয়ার অধিবাসীদের ব্যবহৃত ভাষাকে উল্লেখ করেন। স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রোয় ব্যবহৃত ভাষার তুলনায় মেসিডোনিয়ার অধিবাসীদের ভাষা কিছুটা ভিন্ন। বুলগেরিয়ানদের মতে আজ থেকে এক শ বছর আগে মেসিডোনিয়ার মানুষ যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করত, সেটা ছিল বুলগেরিয়ানদের ভাষার ঠিক অনুরূপ। কিন্তু দীর্ঘদিন সার্বিয়ার সঙ্গে যুগোস্লাভিয়ার অংশ হিসেবে থাকায় তাদের ভাষা সার্বিয়ার ভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আজকের এ অবস্থা ধারণ করেছে। অন্যদিকে যেহেতু গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের জন্ম মেসিডোনিয়াতে তাই গ্রিসও মেসিডোনিয়ার তাদের নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে যদিও সম্প্রতি গ্রিসের চাপে মেসিডোনিয়া তার নাম পরিবর্তন করে উত্তর মেসিডোনিয়া রেখেছে।
সার্বিয়ানদের দাবি অনুযায়ী স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, মন্টেনিগ্রো, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা সব হচ্ছে গ্রেটার সার্বিয়ার অংশ। বেশির ভাগ সার্বিয়ানের ভাষ্য অনুযায়ী রোমান ক্যাথলিক চার্চের চাপের কাছে নতি স্বীকারের কারণে স্লোভেনিয়া এবং ক্রোয়েশিয়ার মানুষ ক্যাথলিক খ্রিষ্টানে রূপান্তরিত হয়েছে এবং তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের শাসকদের দুঃসহ অত্যাচারের প্রভাবে বসনিয়ার অধিবাসীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের পূর্বপুরুষদের সবাই ছিল অর্থোডক্স খ্রিষ্টান। আর আলবেনিয়ার অধিবাসীদের তারা ইউরোপের অধিবাসী হিসেবে পরিচয় দিতে নারাজ। তাদের মতে, আলবেনীয়রা হচ্ছেন যাযাবর জাতি যাঁরা এসেছেন এশিয়ার কোনো অঞ্চল থেকে এবং ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে আজ ইউরোপ মহাদেশে তারা নিজেদের একটি আবাসভূমির দাবি তুলেছে। এ জন্য কসোভোকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে তারা নারাজ। এমনকি যুগোস্লাভ যুদ্ধের সময় ক্রোয়েটসহ বসনিয়া ও কসোভোর অধিবাসীদের ওপর চালানো গণহত্যার জন্য সার্বিয়ার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইলেও এ ঘটনাকে তারা গণহত্যা হিসেবে সব সময় অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। সার্বিয়ানদের অনেকে আজও স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, মেসিডোনিয়া, মন্টেনিগ্রো, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা এবং কসোভো সব রাষ্ট্রকে একীভূত করে গ্রেটার সার্বিয়া গঠনের স্বপ্ন দেখে।
* লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিসা, স্লোভেনিয়া।
( লেখাটি প্রথম আলো থেকে সংগৃহিত )
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply