সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২০ পূর্বাহ্ন
পথে যেতে যেতে আরিফের মনে পড়ল তার তো আজ টিউশনিতে যাবার কথা নয়। কিন্তু কেন সে ঘর থেকে বের হল নিজেই বুঝতে পারছে না। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে তার পাঁচটি প্রাইভেট টিউশনির সবকটিই তো প্রায় বন্ধ।
করোনার কারণে গত চারমাস ধরে বন্ধ থাকায় তার আয় রোজগারের পথ একপ্রকার নেই বলা যায়। মাথায় নানা চিন্তার ঘুরপাকের মধ্যে মুখে মাস্ক দিয়ে বাসা থেকে আনমনা হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল সে।
দুটো টিউশনির থেকে বেতন পাবার কথা ছিল। কিন্তু গত তিনমাস ধরে পড়ানো বন্ধ থাকায় সেখান থেকে বেতন নেয়ার পথও বন্ধ হয়ে বসে আছে। বলেছে, করোনাকাল শেষ হলেই তার সাথে যোগাযোগ করবে।
যেখানে টিউশনি করে তারা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে বন্ধ রেখেছে, কিন্তু তার মতো প্রাইভেট টিউশন যারা করে তাদের জীবনের কথা কে ভাববে। এসব বিষয় কয়দিন ধরে আরিফ হাসানকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
ছোট দুই বোন ও মা-বাবাকে নিয়েই তাদের সংসার। আরিফের প্রাইভেট টিউশনির টাকাতেই একপ্রকার পরিবারের ভরণপোষণ চলে। গত সাত-আটবছরে এভাবেই চলে আসছে। কিন্তু করোনাকাল তাদের জীবনপথের ছন্দপতন ঘটিয়েছে।
গত মার্চ মাসের শেষ থেকেই প্রাইভেট টিউশনিতে যাওয়া বন্ধ আরিফের। আয় নেই, কিন্তু পারিবারের খরচ তো থেমে নেই। প্রতিদিনের আনাজপাতি বাজার, মুদির দোকানের সওদা, ঘর ভাড়া, বিদ্যুতের বিল কোন খরচই তো থেমে নেই।
আষাঢ়ের শুরুর দিকের একটি দিনের শেষ বিকেল, আকাশে মেঘ নেই, রোদ পড়ে আসা বিকেলে জামালখান রোড ধরে একা পথ চলতে থাকে আরিফ। গন্তব্য তার জানা নেই। পথ চলতি মানুষ গোনার চেষ্টা করে।
গুনতে গুনতে একসময় বিরক্ত লাগে। নিজের নাকমুখে গুঁজে থাকা মাস্কটা অন্যমনস্কভাবে একবার হাত দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করতে গিয়ে ভাবে বার বার হাত দিয়ে ধরাটা তো অস্বাস্থ্যকর।
আনমনে এসব ভাবতে গিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনের ফুটপাথ ধরে দুই বাচ্চা
ছেলেকে নিয়ে রাস্তা পার হতে যাওয়া এক মায়ের দিকে চোখ পড়ে তার। বাচ্চা দুটির
মুখে মাস্ক থাকলেও মায়ের মাস্কটা থুতনির নিচে।
পাশ দিয়ে হেঁটে চলা আরেকজন পথচারীর দিকেও চোখ যায় তার। সে এবারেও অবচেতন
মনে পথচারীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে মাস্ক ঠিকঠাক মতো পড়েছে কি
না। কিন্তু মাঝ বয়েসী ওই পথচারীর মুখে মাস্ক না দেখে কিছুটা হতাশ হয়।
উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকা আরিফ হাসান আবার মানুষের মুখে মাস্ক আছে কি
না তা পরখ করতে থাকে। প্রেসক্লাবের সামনে থেকে জামালখান মোড় পর্যন্ত
আটজনকে সে দেখে, পাঁচজনের মুখে মাস্ক আছে। বাকি তিনজনের মুখে না দেখে মনে
মনে হতাশ হয়।
জামালখান মোড়ে এসে ফুটপাথে নতুন বসানো একটা বেঞ্চে বসে পড়ে আরিফ। পকেট থেকে
সিগারেট বের করে ধরায় আর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জোরে এক টান দেয়। মুখভর্তি
ধোঁয়া ছেড়ে হঠাৎ আনমনা হয়ে যায় আরিফ।
মহামারিকাল চলছে সারাবিশ্বে। অর্থনীতিসহ সবক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে
করোনা। তার মতো ছাপোষা গৃহশিক্ষক শুধু নয়, নিম্ন আয়ের মানুষ জনের অবস্থাও
এখন সঙ্গীন। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার মাস দুইয়েক সাধারণ ছুটি দিয়েছে,
সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলেছে, কে শোনে কার কথা এ গরীব
দেশে।
মানুষ যে যেমন পারছে চলছে, দিনযাপন করছে, গাঁ ঘেঁষাঘেষি করে দিন কাটাচ্ছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণও সারাদেশের মত এই শহরেও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। কারও কোন
ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাইরাসের মহামারিকালে মানুষে মানুষে নিয়ম ভাঙ্গার পাল্লা
দেয়ার প্রতিযোগিতা থাকলেও অনেকেই যারা নিয়ম মানার চেষ্টা করছে তারাই আছে
সবচেয়ে বিপদে।
আরিফ তার ধরানো সিগারেটে সর্বশেষ টান দিয়ে ফিল্টারটি একপ্রকার জোরের সাথে
রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। ভাবে করোনাকাল শুরুর সময়েও সে খেতো ১৩টাকার বেনসন।
তিনমাসের ব্যাবধানে সে ব্রান্ড পাল্টে এখন তিনটাকার ডার্বিতে ঠেকেছে। ভাগ্য
ভালো করোনার কারণে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর এখন আগের মতো নেই। তবে
মাঝেমধ্যে তাদের সাথে দেখা হলে আগের মতো বেনসনই খায়।
আরিফ এসব উল্টাপাল্টা ভাবনা ভাবতে ভাবতে উঠে পড়ে। আবারও উল্টোপথ দিয়ে
উদ্দেশ্যহীন হাঁটা শুরু করে। হঠাৎ মাথা কেমন যেন ফাঁকা লাগতে শুরু করে তার।
চিন্তার গ্যাড়াকলে প্রায় অস্থির আরিফ আবারও পথ চলতি মানুষের মাস্ক দেখতে
শুরু করে। সে ভাবে এটা কী আসলেই মাস্ক নাকি মুখোশ। ভেতরকার আমিকে
করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে মুখোশের আড়ালে মানুষ কোন নিজেকে ঢেকে রাখার
চেষ্টা করছে, বুঝার ও ভাবার চেষ্টা করে আরিফ।
আসলেই কি মুখোশের দোহাই দিয়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে পারবে? নাকি
মানুষের ভেতরে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ভয় কমাতে বিজ্ঞানীদের বা বিশেষজ্ঞদের
দেয়া একটা ফতোয়া এটি। ভেবে কূল পায় না আরিফ।
তবে বৈজ্ঞানিকভাবে মুখোশ পড়া ও স্বাস্থ্যবিধি মানলে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস
থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করার চেষ্টা করে সে। সেকারণেই
তো গত তিন-চারমাস ধরে নানা সংকটেও সব নিয়ম মানার চেষ্টা করে যাচ্ছে আরিফ।
হাঁটতে হাঁটতে আবারও মানুষ গোনার চেষ্টা করে সে, দেখতে থাকে মানুষের মুখের
মাস্ক, এক দুই তিন করে সাতাশ জনকে গোনা শেষ হলে চেরাগী পাহাড় মোড়ে এসে
পৌঁছায়। মোড়ের কাছাকাছি ছায়ায় একটা ভ্যানে করে আম বিক্রি করছিল। অভ্যাসবশত
দর জিজ্ঞেস করে বসে বিক্রেতার কাছে। প্রায় এক সাইজের হলুদাভ সবুজ ল্যাংড়া
আম দেখে আগ্রহি হয় আরিফ। ভাবে, বাসার জন্য কয়েক কেজি নেয়ার কথা।
এ মৌসুমে এখনো পর্যন্ত আম নেয়া হয়নি বাসায়। করোনাকালের কারণেই এ সংকট।
অন্যান্য বছর এ সময়ে প্রায় প্রতিদিনই আম নিয়েই বাসায় যেতো আরিফ। পকেট গড়ের
মাঠ জেনেও সে ল্যাংড়া আমের দর জিজ্ঞেস করে। বিক্রেতা প্রতিকেজি আশি টাকা
বললেও আরিফ সত্তর টাকা পর্যন্ত বলে ক্ষান্ত দেয়।
চেরাগী পাহাড়ের ভেতর চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আরিফ। সেখানে দেখা
সাংবাদিক খালেদের সাথে। খালেদ শরিফ, স্থানীয় একটি পত্রিকার রিপোর্টার।
দুইজনেই প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর করোনাভাইরাসের মাহমারিকালে জীবন জীবিকা
নিয়ে আলোচনা শুরু করে। এক পর্যায়ে দুইজনে চায়ের অর্ডার দেয়। চা খেতে খেতে
চলে তাদের আড্ডা। সেখানে চেরাগীর আড্ডাবাজদের মধ্যে আরও কয়েকজন এসে জোটে।
এভাবে সময় এগুতে থাকে। একসময় খালেদ শরিফ বিদায় নেয়, কিন্তু আরিফ হাসান
রয়ে যায়। বুঝতে পারে না কোথায় যাবে। মৃদু পায়ে হেঁটে অদূরে নন্দন বই ঘরের
দিকে যেতে থাকে। দোকান থেকে একটি চেয়ার নিয়ে বাইরের বারান্দায় বসে আরিফ।
মুখের মাস্কটি খুলে শার্টের ওপরের পকেটে রাখে এবং প্যান্টের পকেট থেকে নিয়ে
আবার সিগারেট ধরায়।
সিগারেটে গভীর টান দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে আরিফের মধ্যে তার
পুরনো ভাবনা আবারও জেগে ওঠে। সে বিকালের দিকে কেনো বেরিয়ে ছিল, কেনই বা
এলোমেলো হাঁটাচলা করছে। তার কোনো হিসেব মেলাতে না পারা আরিফের সামনে
সবকিছুই যেনো ধোঁয়াশা মনে হতে থাকে।
করোনাকাল কিভাবে মানুষের জীবনকে পাল্টে দেয় নিজেকে দিয়ে তা বুঝতে চেষ্টা
করে আরিফ। ভাবে, তার তো এ সময়ে এই চেরাগী পাহাড়ে বসে থাকার কথা ছিল না,
থাকার কথা ছিল টিউশনিতে। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে সে না
পারছে সইতে না পারছে বলতে।
টিউশনি করে সম্মানজনক আয়ই প্রতিমাসেই হত। তা দিয়ে পাঁচজনের পরিবারের ভালই
চলে যেত। মাস্টার্স পাশ আরিফ অন্য কোন চাকরি না করে স্বাধীন জীবন যাপন করবে
বলে টিউশনিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের চাপ থাকা সত্ত্বেও
এখনও পর্যন্ত যুৎসই কোন চাকরিও আদতে মেলেনি। তবু তার কোন খেদ ছিল না।কিন্তু
করোনাকাল এসেই তার জীবনের গতি পুরোপুরি উল্টে দিয়েছে।
বাসায় চাল কিনতে হবে, তার আম্মা বলেছে কাঁচা বাজারও নিতে। পকেট এখন গড়ের মাঠ। কি করবে বুঝতে পারছে না কিছু্।
আরেকটি সিগারেট ধরায় আরিফ, কেমন যেন বিরক্ত লাগে তার। সিগারেটখোরদের
নাকি করোনাভাইরাস বেশি আক্রমণ করতে পারে। এমন একটা খবর সে কয়েকদিন আগে
ফেসবুকের কল্যাণে জানতে পেরেছে।
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে নিয়মিত মাস্ক পড়া, বাড়ির বাইরে বের না হওয়া,
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ বিভিন্ন নিয়ম মানছে আরিফ। কিন্তু সিগারেটটা
ছাড়তে পারছে না কিছুতেই। একবার ভাবছিল ছেড়েই দিবে, কিন্তু পারে নি।
দুই মাসের বাসা ভাড়া বাকি পড়েছে, সিগারেটে আরেকটা গভীর টান দেয় আরিফ।
বাড়িওয়ালা ভাড়া পরিশোধের জন্য পঞ্চমদফায় ওয়ার্নিং দিয়েছে। কি করবে কিছু
ভেবে কূল পাচ্ছে না সে। কারও কাছে বিশেষ করে কোন বন্ধুর কাছে হাত পাতবে তাও
ভাবতে পারছে না। করোনা মহামারিতে সবার অবস্থায় তথৈবচ।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে, চেরাগী পাহাড়ের দোকানপাট বন্ধ হচ্ছে। লোকজনও
রাস্তায় কমে গেছে। করোনাকাল শুরুর পর থেকে এমনিতেই রাস্তাঘাটে সন্ধ্যের পর
মানুষ কমে যায়। তিন-চারমাস আগেও এই চেরাগী পাহাড় মোড় সন্ধ্যার পর জমজমাট
হয়ে উঠতো। রাত এগারটা-বারটা পর্যন্ত জমজমাট থাকতো এই চেরাগী পাহাড়।
এবার ওঠা দরকার, উঠেই পড়ে আরিফ। বাসার পথে পায়ে হেঁটে এগোয়। ল্যাংড়া আম
নিয়ে এখনো সেই বিক্রেতা হাঁক পাড়ছে। এবারের মৌসুমে এখনও পর্যন্ত আম কেনা
হয়নি বাসার জন্য। সেটা মনে পড়তেই বুকের বাম পাশটায় কেমন যেন একটু মোচড় দিয়ে
ওঠে আরিফের।
পথ চলতে চলতে আবারও মানুষ দেখে, মানুষের মুখে লাগানো মাস্ক দেখে। ভাবে.. কি প্রানান্ত চেষ্টা করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার মানুষের চেষ্টা। এখন আর মানুষের পুরো চেহারাটাও দেখতে পাওয়া যায় না ভাল করে।
পাঁচটি টিউশনের তিনমাসের টাকা বকেয়া পড়ে থাকার কথা আবারও মনে পড়ে আরিফের। দুই মাসের বকেয়া বাসা ভাড়া, ঘরের বাজার করা, দিন ঠিকমতো চলতে না পারার কথা তাকে আবারও ভাবিয়ে তোলে।সব ছাপিয়ে করোনাভাইরাস নিজেকে বেকার করে তোলার বিষয়টি আরিফকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে।
মোমিন রোড পার হয়ে আন্দরকিল্লার দিকে বাড়ানো পথে ভর সন্ধ্যাবেলা সবকিছু ছাপিয়ে আবারও মানুষ দেখার চেষ্টা করে আরিফ। মাস্ক… না মাস্ক নয় মুখোশ পড়ে থাকা মানুষগুলোর … আড়ালে থাকা দুঃখ বোঝার চেষ্টা করে।
( লেখাটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে সংগৃহিত )
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply