বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৮ অপরাহ্ন
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদ্যপ্রয়াত সাংসদ সাহারা খাতুনকে আমার কাছ থেকে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে ৫ দিন। ২০ ঘণ্টার কিছু কম বা বেশি সময় তার মুখোমুখি বসেছি, দেখেছি কি সাদাসিধে এক জীবন যাপন তার।
ঘটনা ২০১৬ সালের। আমার কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় একটি মামলায়, যেটি পরে আদালত খারিজ করে দিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে আমি তখন কথা বলি কক্সবাজারের মেয়ে, আমাদের বড় বোন লীনা আপার সাথে। তিনিই পরামর্শ দিলেন সাহারা আপার কাছে যাওয়ার। সেই সূত্রেই তাকে অল্প কিছুক্ষণ দেখা, পাঁচদিনে মাত্র ২০ ঘণ্টা।
প্রথমদিন আমি সাহারা খাতুনের চেম্বারে ঢুকলাম। লীনা আপা আগে থেকেই বসে আছেন সেখানে। সাহারা আপা আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, “যাদের জন্য এসেছ তারা কী কোনও অন্যায় করেছে?”
উত্তরে আমি বললাম, “না আপা ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
এরপর মামলার এজাহার দেখলেন। সেখানে লেখা ছিল- “আসামীদের কাছ থেকে একটা ‘পাওয়ার ব্যাংক’ উদ্ধার করার হয়েছে।”
আমাকে অবাক করে দিয়ে লীনা আপার কাছে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “পাওয়ার ব্যাংক কী?”
লীনা আপা উত্তরে বললেন, “এটা দিয়ে মোবাইলে চার্জ দেয়া হয়, আপা।”
সাহারা আপা তখন বললেন, “আমাকে একটু দেখাতে পারবে জিনিসটা।”
লীনা আপা কোথা থেকে যেন একটা ‘পাওয়ার ব্যাংক’ এনে সাহারা আপার হাতে দিলেন। তিনি সেটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমি তো ভেবেছি মোবাইল শুধু কারেন্ট দিয়েই চার্জ দেওয়া হয়, প্রযুক্তি কত এগিয়ে গেছে।’
এরপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমরা কত ভাগ্যবান দেখেছো, উন্নত প্রযুক্তির পৃথিবী তোমাদের। এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক রাজনীতি করার সময় কিন্তু তোমাদের এখন।”
আমি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। কতটা সাদাসিধে জীবন হলে রাষ্ট্রের এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মোবাইলের ‘পাওয়ার ব্যাংক’ চেনেন না!
ওই পাঁচদিনের মধ্যেই আরেকদিন দুপুরের ঘটনা। আমরা বসে আছি। দুপুরের খাবার সময় হয়েছে। চেম্বারে একজন গানম্যান থাকতেন সাহারা খাতুনের। তাকে ডেকে ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন, ‘যাও লাঞ্চ করে আসো’।
উনি টাকা নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে আসলেন- তখন সাহারা আপা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী খেয়েছো, নাকি টাকা পকেটে রেখে দিছো’।
গানম্যান লোকটা এমন মধুর হাসি দিয়ে বললেন, ‘খেয়েছি’। এমন হাসি একজন সন্তান তার মায়ের সামনে দেয়। আমি ওদিন দেখলাম সাহারা আপা হচ্ছেন মায়েদের প্রতিচ্ছবি।
এই পাঁচদিন আরও নানা ছোটোখাটো ব্যাপার দেখেছি। অনেকের মামলা তিনি টাকা ছাড়া পরিচালনা করতেন।
আমাদের মামলা প্রসঙ্গে লীনা আপাকে বলেছিলেন, ‘শোন ওরা ছাত্রলীগ করে। টাকা পয়সা কিন্তু বেশি নাই ওদের কাছে। আমার ফি যতটুকু দিতে পারে ততটুকুই রাখবা। এই নিয়ে কিন্তু কোন কথা বলবানা ওদের’। লীনা আপা হেসে বললেন ঠিক আছে।
আমি ওই পাঁচদিন দেখেছি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, একজন সাংসদ কতটা সাদাসিধে হয়! বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয় বাস্তবায়িত হবেই, সেদিন মনে হয়েছিল। কারণ শেখ হাসিনার সাথে আছেন সাহারা খাতুনরা। যারা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিটি নেতা-কর্মীকে একই স্নেহে বুকে টেনে নিতে জানেন। যাদের কাছে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগ-ই শেষ কথা। যাদের পুরো বুক জুড়ে বাংলাদেশ, আর সেখানে প্রতিদিন প্রতিধ্বনিত হতে থাকেন পিতা মুজিব।
সাহারা খাতুন নিয়ে কথা বলার মতো যথেষ্ঠ জ্ঞান-গরীমা-প্রজ্ঞা এমনকি রাজনৈতিক গভীরতাও আমার নেই। কেবল এটুকু বলতে পারি, তাকে খুব কাছ থেকে ২০ ঘণ্টা দেখার পর নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছিল। আমরা তো তরুণ কর্মী, ফলে সবকিছু পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে রাজনীতিও।
সাহারা আপাকে দেখে বুঝেছি, আদর্শের রাস্তায় চলতে হলে ভালোবাসার বিকল্প কিছু নেই। আদর্শের রাস্তা এতোটাই সোজা যে জটিল জগতের জটিল মানুষদের কাছে সেটাকে প্রহেলিকা মনে হয়। অথচ সেই সরল রাস্তায় সাহারা খাতুনরা সহজেই হেঁটে যান একটা পুরো জীবন। সে রাস্তা অন্ধকার হলেও তাদের ভয় লাগেনা। কারণ তারা নিজেদের প্রজ্ঞাতেই আলোকিত করে যান পথ। আলোর উৎস কখনো আলো খোঁজে না।
সাহারা খাতুনের অসুস্থতার খবরে দু:খ পেয়েছিলাম। আশংকা নিয়ে ভাবতাম কবে আওয়ামী লীগকে আরেকটু শূন্য করে চলে যাবেন। তবে এও ঠিক যতোটা দিয়েছেন, তা দিয়ে পূর্ণ করে রেখে গেছেন। বাকি দায়িত্ব আমাদের।
ভালো থাকবেন সাহারা খাতুন, বাংলাদেশ আপনাকে ভুলবে না, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আপনাকে ভুলবে না।
( ইশতিয়াক আহমেদ জয়: সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কক্সবাজার জেলা শাখা। )
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply