বিশেষ প্রতিবেদক: চাহিদা মিটিয়ে গত অর্থবছরে উৎপাদিত লবণের মজুদ থাকার পরও চলতি মৌসুম শুরুর আগেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক আমদানির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন চাষী ও মাঠ মালিকরা।

তারা বলছেন, গত অর্থবছরে চাহিদা ও লক্ষ্যমাত্রার চাইতে বেশী উৎপাদিত লবণ এখনো মাঠে আর মিলে মজুদ রয়েছে। আর কিছুদিন পরই চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদন শুরু হবে। এতে লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হলে চাষীরা ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবেন।

সোমবার বিকালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের শহীদ এটিএম জাফর আলম মিলনায়তনে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘লবণ চাষী ও লবণ শিল্প মালিকদের’ সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্টিত হয়। এতে লবণ চাষী, মাঠ মালিক ও লবণ শিল্প মালিকরা হতাশাজনক এ মতামত ব্যক্ত করেন।

বৃহস্পতিবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক সভায় চলতি অর্থ-বছরে ৩ লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন লবণ আমদানির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে সোমবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসন লবণ চাষী ও লবণ শিল্প মালিকদের সঙ্গে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক ) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এর উপ-মহাব্যবস্থাপক (উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ) মো. সারোয়ার হোসেন ‘লবণ শিল্পের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তথ্য-চিত্র’ তুলে ধরেন।

বিসিকের উপস্থাপিত তথ্য মতে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৭ হাজার ৬৯৭ জন চাষী ৫৪ হাজার ৬৫৪ একর জমিতে লবণ চাষ করেন। এতে ২২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৯ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। এই অর্থবছরে লবণ উৎপাদিত হয় পূর্বের মজুদসহ ১৯ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন।

অন্যদিকে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত লবণ মজুদ রয়েছে ৩ লাখ ৪ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে মাঠ পর্যায়ে ১ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন এবং মিল পর্যায়ে ১ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন।

সভায় বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার হোসেন বলেন, দেশে কক্সবাজার জেলার সদর, নবগঠিত ঈদগাঁও, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া এবং চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলা কিছু অংশেই মূলত লবণ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বর্তমানে প্রতিবছর কম বা বেশী ৬০ হাজার একর পর্যন্ত জমিতে লবণ চাষ হয়ে থাকে। প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মধ্য মে মাস পর্যন্ত সময়কালেই লবণ উৎপাদনের মৌসুম। মূলত এই সময়ে উৎপাদিত লবণ দিয়ে দেশে সারা বছরের চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে।

“ এতে গত অর্থবছরে বাজারজাতের পরেও মাঠে ও মিল পর্যায়ে এখন পর্যন্ত লবণ মজুদ; রয়েছে ৩ লাখ ৪ হাজার মেট্রিক টন। যা দিয়ে অন্তত আগামী আরো ৩ মাস পর্যন্ত লবণের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। ”

বিসিকের এ কর্মকর্তা বলেন, “ লবণ একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। আবহাওয়ার অনুকূল পরিস্থিতির উপর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নির্ভর করে। আর আবহাওয়ার পরস্থিতি প্রতিকূলে থাকলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে আমদানির মাধ্যমে দেশের লবণের চাহিদা মেটানো হয়। ”

“ আর কিছুদিন পরেই চলতি মৌসুমে মাঠে উৎপাদিত লবণ বিক্রি ও বাজারজাতকরণ শুরু হবে। এই সময়ের মধ্যে গত অর্থবছরে মজুদকৃত লবণ দিয়ে দেশেশর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে ” বলেন বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক সারোয়ার হোসেন।

জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় লবণ চাষী ও লবণ শিল্প মালিকরা ছাড়াও বিসিকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্থানীয় সংসদ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

এতে শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রাথমিকভাবে লবণ আমদানির সিদ্ধান্তে হতাশা ব্যক্ত করে নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের গোমাতলী এলাকার লবণ চাষী রেজাউল করিম সুজন বলেন, এমনিতেই সিন্ডিকেট কারণে মাঠ পর্যায়ে লবণ চাষীরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরী বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবছর উৎপাদন খরচও বেড়ে চলছে। এতে প্রতিবছর লবণ চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এর মধ্যে চলতি লবণ উৎপাদনের শুরুতেই সরকারের বিদেশ থেকে লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হলে চাষীদের মাথা হাত দেওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না বলে মন্তব্য করেন প্রান্তিক এ লবণ চাষী।

একই ধরণের মন্তব্য করে মহেশখালী উপজেলার হোয়ানকের লবণ চাষী আব্দুল করিম বলেন, গত মৌসুমে লবনের উৎপাদন খরচের চাইতে বাজারমূল্য কম থাকায় তার মাঠের গুদামে ৫ মেট্রিক টন মজুদ রয়েছে। তাই চলতি মৌসুমে লবণ চাষের পরিমান কমিয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “ গত ১৫ একর জমিতে লবণ চাষ করলেও চলতি মৌসুমে ১০ একর চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই অনুয়ায়ী লবণ চাষের প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে সরকারের বিদেশ থেকে লবণ আমদানির সিদ্ধান্তে তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। ”

টেকনাফের লবণ চাষী ও ব্যবসায়ি শফিক মিয়া বলেন, চলতি মৌসুমের শুরুতে সরকারের বিদেশ থেকে লবণ আমদানির সিদ্ধান্তে তারা উৎকণ্ঠিত। কারণ গত ৭/৮ বছর ধরে প্রান্তিক চাষীরা লবণের ন্যায্য বাজারমূল্য পাচ্ছে না। এরই মধ্যে সরকারের লবণ আমদানির সিদ্ধান্তে উৎপাদনে চাষী আগ্রহ হারানোর পাশাপাশি ক্ষতির মুখে পড়বে।

সভায় অংশ নিয়ে কক্সবাজারের মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, মাঠে ও মিল পর্যায়ে এখনো গত অর্থবছরে উৎপাদিত বিপুল পরিমান লবণ মজুদ রয়েছে। এই মুহুর্তে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করলে যখন এসে পৌঁছাবে তখন কিন্তু চলতি মৌসুমে উৎপাদিত দেশিয় লবণে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে। এতে লবণ আমদানির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন না।

“ তারপরও লবণের চাহিদার ঘাটতির বিষয়টি আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব না, সেটা নীতি-নির্ধারণী কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে দেখবেন। আমরা পরামর্শ দিয়েছি, জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে কি পরিমান লবণ আগের মজুদ আছে; সেটা যাচাই করে আগামী ১০/১৫ দিনের যদি চাহিদা মেটায় তাহলে ঘাটতি থাকার কথা নয়। কারণ এই সময়ের মধ্যে চলতি মৌসুমের উৎপাদিত লবণ বিক্রি এবং বাজারজাতকরণ পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে। ”

এতে মিল মালিক ও বাজারে লবণের চাহিদার সংকট থাকার কথা নয় এ বিষয়টি সভায় সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তুলে ধরেছেন বলে জানান স্থানীয় এ সংসদ সদস্য।

যে পণ্যের আমদানির সিদ্ধান্ত চাহিদা ও যোগানের ভিত্তিতে সরকারের উর্ধ্বতন মহল নিয়ে থাকেন বলে মন্তব্য করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা।

জাকিয়া সুলতানা বলেন, আমদানির সিদ্ধান্ত সরাসরি শিল্প মন্ত্রণালয় দিতে পারে না। এক্ষেত্রে চাহিদার প্রেক্ষিতে কি পরিমান ঘাটতি রয়েছে তা নিরূপন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ আকারে পাঠানো হয়। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সকল স্টক-হোল্ডারদের নিয়ে সভা করেন।

“ এতে যারা প্রকৃত লবণ আমদানিকারক তাদের তথ্য নেওয়া হয়। যাচাই-বাছাই করা হয়। তারপর তারা (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়) অনুমোদন দেয়। ”

শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, “ এটা ( লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত ) একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। যেহেতু এখন লবণ উৎপাদনের ভর মৌসুম (পিক সিজন) আমরা ধরে নিচ্ছি যে, এটা (আমদানি) আমরা করবো না। যাতে আমাদের চাষীরা ন্যায্যমূল্য পায়। সেটা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিশ্চিত করা হবে। ”

“ পরেই যদি সত্যিকার অর্থে ঘাটতি বা সংকটের পরিস্থিতি তৈরী হয়, একান্তই যদি জরুরি হয়; তখনই লবণ আমদানির চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কারণ লবণ এমন একটা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সেটার ঘাটতি রেখে সরকারকে আমরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে চাই না। ”

এ ব্যাপারে সরকারের নীতি-নির্ধারণী মহল প্রথমদিক থেকে সচেষ্ট রয়েছে; যাতে যে কোন পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য লবণের ঘাটতি না পড়ে বলে মন্তব্য করেন জাকিয়া সুলতানা।

সভায় বক্তব্য রাখেন, বিসিক চেয়ারম্যান অতিরিক্ত সচিব মো. মোশতাক আহমদ, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আইনজীবী ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী, টেকনাফ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শফিক মিয়া, মহেশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শরীফ বাদশা, মহেশখালী পৌর মেয়র মকছুদ মিয়া, কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রি’র সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা, বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক এসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কবির, লবণ চাষী কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী ও প্রান্তিক লবণ চাষী সাজেদুল করিম প্রমুখ।

nupa alam

Recent Posts

মিয়ানমারে বিস্ফোরণে মুহুর্মুহু শব্দ, টেকনাফের বসত ঘরের আঙ্গিনায় এসে পড়েছে গুলি

নিজস্ব প্রতিবেদক : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের আশেপাশে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান…

7 hours ago

মাকে কুপিয়ে হত্যার পর থানা এসে হাজির যুবক

নিজস্ব প্রতিবেদক : কক্সবাজার শহরের পশ্চিম বড়ুয়া পাড়ায় মাদকের টাকা না পেয়ে মাকে কুপিয়ে হত্যা…

12 hours ago

টেকনাফ ছাড়াও এবার নতুন করে উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান…

3 days ago

চকরিয়ায় জেলা পরিষদের জমিতে নির্মিত আওয়ামী লীগের অফিস উচ্ছেদ

চকরিয়া প্রতিবেদক: চকরিয়ায় জেলা পরিষদের মালিকানাধীন জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অফিস উচ্ছেদ…

3 days ago

সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও জাহাজ ছাড়ার পয়েন্ট নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটি গঠণ

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও সেন্টামর্টিনগামী জাহাজ ছাড়ার…

3 days ago

সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে কক্সবাজার শহরে এসে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসির সড়ক অবরোধ

নিজস্ব প্রতিবেদক : সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে ‘পর্যটক সীমিতকরণ ও রাত্রিযাপন নিষিদ্ধসহ বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের’ দাবিতে কক্সবাজার…

4 days ago