১ মার্চ ১৯৭১: ইয়াহিয়ার কূটচাল, প্রতিবাদে উত্তাল বাংলা

বিডিনিউজ : বাংলাদেশের ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণের সূচনা হয়েছিল একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চে।

১৯৭০ সালের গণপরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটে নির্বাচিত দলের সঙ্গে নানা কূটচাল শুরু হয়।

একাত্তরের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয়েছিল, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে ৩ মার্চ। কিন্তু পয়লা মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিক এক বেতার ভাষণে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, পাকিস্তানের একটি প্রধান দল পিপলস পার্টি এবং অন্য কয়েকটি দল ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

বেতারে ওই ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে রাজধানী ঢাকা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা স্টেডিয়ামে বিসিসিপি ও আন্তর্জাতিক একাদশের মধ্যে অনুষ্ঠানরত ক্রিকেট ম্যাচ ভণ্ডুল হয়ে যায়। দর্শকরা স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে মিছিলে শরিক হন।

মিছিলগুলো আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার জন্য মতিঝিলে হোটেল পূর্বাণীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

অধিবেশন স্থগিত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকার বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা বিমানবন্দর এবং পি আইএর মতিঝিল অফিসের কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস ছেড়ে চলে যান। বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন রুটে এবং আন্তঃদেশীয় রুটে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক শেষে হোটেল পূর্বাণীতে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার কঠোর প্রতিবাদ জানান। তিনি ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকা শহরে এবং ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেন।

৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন বলে জানান।

পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রধান আবদুল কাইয়ুম খান প্রেসিডেন্টের ঘোষণাকে ‘একমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত’ হিসেবে অভিহিত করে স্বাগত জানালে এর প্রতিবাদে মহাসচিব খান এ সবুর দলের সদস্যপদ ও সম্পাদকের পদ ছাড়ার ঘোষণা দেন।

রাতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসনকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা এম এয়াকুব খানকে প্রদেশের বেসামরিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

গভীর রাতে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক এক নতুন আদেশ জারি করে সংবাদপত্রে দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো খবর বা ছবি প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন।

পিপলস পার্টি ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে ২ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানে যে সাধারণ ধর্মঘট পালনের আহবান জানিয়েছিল, প্রেসিডেন্টের ঘোষণার প্রেক্ষিতে সন্ধ্যায় তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

একাত্তরের ১ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘প: পাক মহিলা আসনে নির্বাচন স্থগিত’।

সেখানে বলা হয়, সদস্যদের উপস্থিত কম হওয়ার আশঙ্কায় জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের মহিলা আসনে নির্বাচন স্থগিত করে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। তবে পূর্ব-পাকিস্তানের নির্বাচন ২ মার্চ হবে বলে।  

ওই দিন ইত্তেফাকের আরেকটি খবর ছিল, ‘আমরা যদি ওই ভাষায় কথা বলি তখন?- ভুট্টো গং এর প্রতি শেখ মুজিব। আসুন, পরিষদের সমাধান খোঁজা যাইবে।’

আগের দিন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির এক সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের ঢাকায় এসে শাসনতন্ত্র রচনায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। ওই সভায় শেখ মুজিব বলেন, ছয় দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র লেখা হবে। এর ভিন্ন হবে না।

তখনকার জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবুল আলা মওদুদীর এক বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর একটি বার্তাও দৈনিক ইত্তেফাকে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। খবরটির শিরোনাম ছিল- ‘বর্তমান সংকট বাংলার নির্বাচনী রায় নস্যাতের প্রয়াস। মওদুদীর তারবার্তার জবাবে শেখ মুজিব।’

ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনার আরেকটি খবরও সেদিন প্রকাশ করে ইত্তেফাক। শিরোনাম ছিল- ‘আওয়ামী লীগ দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করিবে। ঢাকা শিল্প ও বণিক সংঘের সংবর্ধনায় শেখ মুজিবের বক্তৃতা।’

খবরে বলা হয়, ওই সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছেন, তার দল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। তবে সেই সামজতন্ত্রে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে নয়, নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পন্থায় ধীরে ধীরে বিবর্তনের মাধ্যমে পৌঁছানো যাবে বলে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।

ওই দিনের ইত্তেফাকে শহীদ মিনারে একটি সমাবেশের খবর প্রকাশিত হয়। ওয়ালী ন্যাপের ওই সমাবেশের খবরের শিরোনাম ছিল- ‘চক্রান্ত প্রতিরোধ করা হইবে।’

ওই জনসভা থেকে নির্বাচনের রায় অনুযায়ী গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং অবিলম্বের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানানো হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন ওয়ালী ন্যাপের প্রদেশিক সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ। বক্তৃতা করেন সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন, মতিয়া চৌধুরী, সাইফুদ্দীন মানিক, কৃষক নেতা জীতেন ঘোষ ও ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম। ওই সভায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কট করায় পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর ‘তীব্র নিন্দা’ জানানো হয়।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংবাদপত্র

nupa alam

Recent Posts

টেকনাফ ছাড়াও এবার নতুন করে উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান…

3 days ago

চকরিয়ায় জেলা পরিষদের জমিতে নির্মিত আওয়ামী লীগের অফিস উচ্ছেদ

চকরিয়া প্রতিবেদক: চকরিয়ায় জেলা পরিষদের মালিকানাধীন জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অফিস উচ্ছেদ…

3 days ago

সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও জাহাজ ছাড়ার পয়েন্ট নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটি গঠণ

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও সেন্টামর্টিনগামী জাহাজ ছাড়ার…

3 days ago

সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে কক্সবাজার শহরে এসে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসির সড়ক অবরোধ

নিজস্ব প্রতিবেদক : সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে ‘পর্যটক সীমিতকরণ ও রাত্রিযাপন নিষিদ্ধসহ বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের’ দাবিতে কক্সবাজার…

4 days ago

পাহাড়ী আস্তানা থেকে মালয়েশিয়া পাচারকালে শিশুসহ ৩১ জন উদ্ধার, দুই দালাল আটক

নিজস্ব প্রতিবেদক : টেকনাফে ‘বেড়াতে গিয়ে অপহরণের শিকার’ যুবকের তথ্যে অভিযান চালিয়ে পাহাড়ী এলাকার গোপন…

4 days ago

সাবের মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর পিএস ফিরোজ কক্সবাজারে গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক : সাবেক পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ব্যক্তিগত সহকারি ( পিএস…

4 days ago