এ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ: শেখ হাসিনা

জাতীয় ডেস্ক : স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার কৃতিত্ব জনগণকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের এই অর্জন তুলে ধরতে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেন, “এ কৃতিত্ব এ দেশের আপামর জনসাধারণের। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি।”

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ভার্চুয়ালি এই সংবাদ সম্মেলন করেন শেখ হাসিনা।

তিনি শুরুতেই বলেন, “আজ অবশ্য আমি আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি বাংলাদেশের একটি মহৎ এবং গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের সুসংবাদ দেওয়ার জন্য।

“বাংলাদেশ গতকাল স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছি।”

লক্ষ্য অর্জনের এই সময়ের গুরুত্ব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের এই উত্তরণ এমন এক সময়ে ঘটল, যখন আমরা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি; আমরা মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের জন্য এ উত্তরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।”

১৯৭৫ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে থাকা বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা ইউএন-সিডিপির সব শর্ত পূরণ করে ২০১৮ সালে।

জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়।

সিডিপি তিনটি সূচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ শর্ত পূরণ করে অনেক এগিয়ে গেছে।

উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশ ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৮২৭ ডলার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার। অর্থাৎ মানদণ্ডের চেয়ে প্রায় ১ দশমিক ৭ গুণ। মানবসম্পদ সূচকে নির্ধারিত মানদণ্ড ৬৬-এর বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ৭৫.৪। অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে উত্তরণের জন্য মানদণ্ড নির্ধারিত ছিল ৩২ বা তার কম। কিন্তু ওই সময়ে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৭।

সিডিপির প্রবিধান অনুযায়ী, উত্তরণের সুপারিশ পাওয়ার পর একটি দেশ তিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রস্তুতিকালীন সময় ভোগ করতে পারে।

নিউ ইয়র্কে ইউএন-সিডিপির ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভায় শুক্রবার রাতে বাংলাদেশের চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন, উন্নয়নের চলমান গতিধারা বজায় থাকলে বাংলাদেশ অচিরেই উন্নত দেশের কাতারে উঠবে।  

“আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।”

তিনি বলেন, “আমি এই অর্জনকে উৎসর্গ করছি আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মকে। যারা আজকের বাংলাদেশকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবে।”

সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা পাকিস্তান আমলে বাংলার বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের পর উন্নয়নের লক্ষ্যে যাত্রার শুরুর কথাও বলেন তিনি।

“একটা প্রদেশের প্রশাসনকে তিনি (বঙ্গবন্ধু) অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে একটা স্বাধীন দেশের উপযোগী করে একেবারে শূন্য হাতে দেশের পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। ভারত থেকে ফিরে আসা এক কোটি শরণার্থীসহ দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষকে পুনর্বাসন করেন। শহীদ পরিবার, নির্যাতিত পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা, ঘরবাড়ি হারানো সকলকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ৭ শতাংশ অতিক্রম করে। বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করে।”

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর বাংলাদেশের উল্টো পথে যাত্রা এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর আবার উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তিনি।

নির্বাসিত জীবন থেকে দেশে ফেরার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “৬ বছর নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর আমি ব্যাপকভাবে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা সফর করি। আমি সে সময়ই প্রতিজ্ঞা করি যদি কোনোদিন আল্লাহ আমাকে সুযোগ দেন দেশ পরিচালনার, তাহলে গ্রামোন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেব। গ্রামের মানুষের উন্নয়নে কিছু করব।

“তখন ৭০-৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করতো। আমার মনে হয়েছিল এদের যদি দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারি, তাহলেই বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে। ১৯৯৬ সালে জনগণের রায় নিয়ে আমি প্রথমবার সরকার গঠন করে আমার চিন্তা-চেতনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।”

শেখ হাসিনা বলেন, “এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।”

বদলে যাওয়া এই দেশকে বুঝতে আর্থিক এবং অন্যান্য সূচকগুলোর দিকে সবাইকে দৃষ্টি দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮-০৯ বছরে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ১০৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ সালে তা ৩৩০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০০৮-০৯ বছরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১৮-১৯ বছরে তা ৪০ দশমিক পাঁচ-চার বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৮-০৯ বছরের ৭ দশমিক চার-সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪ দশমিক শূন্য-তিন বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০০১ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ এবং হত-দারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪.৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২০.৫ ভাগ এবং হত-দারিদ্র্যের হার ১০.৫ শতাংশে।

২০০৯-১০ সালে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ছিল ৫,২৭১ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে উন্নীত  এবং বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয় এবং মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও স্বয়ং-সম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।

উন্নয়ন অভিযাত্রায় ’ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর সুবিধা শহর থেকে প্রান্তিক গ্রাম পর্যায়েও বিস্তৃত হওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথাও তিনি বলেন।

করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে গণ টিকাদানের বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি প্রত্যয়ী ও মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে জায়গা করে নেবে।

তবে এ অর্জনকে সুসংহত এবং টেকসই করার উপর জোর দেন তিনি।

এলক্ষ্যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, “বাঙালি বীরের জাতি। মাত্র নয় মাসে আমরা আমাদের স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের এই উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত-সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

“আসুন, দলমত নির্বিশেষে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করি।”

nupa alam

Recent Posts

টেকনাফ ছাড়াও এবার নতুন করে উখিয়া-নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান…

1 day ago

চকরিয়ায় জেলা পরিষদের জমিতে নির্মিত আওয়ামী লীগের অফিস উচ্ছেদ

চকরিয়া প্রতিবেদক: চকরিয়ায় জেলা পরিষদের মালিকানাধীন জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত লক্ষ্যারচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অফিস উচ্ছেদ…

1 day ago

সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও জাহাজ ছাড়ার পয়েন্ট নির্ধারণ সংক্রান্ত কমিটি গঠণ

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন নিয়ন্ত্রণ ও সেন্টামর্টিনগামী জাহাজ ছাড়ার…

1 day ago

সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে কক্সবাজার শহরে এসে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসির সড়ক অবরোধ

নিজস্ব প্রতিবেদক : সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে ‘পর্যটক সীমিতকরণ ও রাত্রিযাপন নিষিদ্ধসহ বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের’ দাবিতে কক্সবাজার…

2 days ago

পাহাড়ী আস্তানা থেকে মালয়েশিয়া পাচারকালে শিশুসহ ৩১ জন উদ্ধার, দুই দালাল আটক

নিজস্ব প্রতিবেদক : টেকনাফে ‘বেড়াতে গিয়ে অপহরণের শিকার’ যুবকের তথ্যে অভিযান চালিয়ে পাহাড়ী এলাকার গোপন…

2 days ago

সাবের মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর পিএস ফিরোজ কক্সবাজারে গ্রেপ্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক : সাবেক পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ব্যক্তিগত সহকারি ( পিএস…

2 days ago