রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৩০ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
টেকনাফে বস্তাবন্দি শিশু হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার ২ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কক্সবাজারে শহীদদের পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ ও অনুদান প্রদান করেছে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’ কুতুবদিয়ায় বিশ্ব নদী দিবস পালিত টেকনাফে নিখোঁজ মেয়ে শিশুর বস্তিাবন্দি মরদেহ উদ্ধার ৩৫ হাজার ইয়াবা সহ পুলিশ কনস্টেবল সহ আটক ২ সেনা কর্মকর্তারা ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতাপ্রাপ্ত : মব জাষ্টিস নিন্দনীয় ৪৮ মামলার আসামী জিয়াবুলের আস্তানায় যৌথ বাহিনীর অভিযান : অস্ত্র উদ্ধার টেকনাফে ৩১ দখলদারের থাবায় ১৪ বছরে নিশ্চিহ্ন ৩০০ বছরের পুরোনো বৌদ্ধ বিহার আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কার পেল সায়মন বিচ রিসোর্ট ও সায়মন হেরিটেজ টেকনাফে ৫ কোটি টাকার মূল্যের ১ কেজি আইসসহ গ্রেপ্তার ১

সেনা কর্মকর্তারা ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতাপ্রাপ্ত : মব জাষ্টিস নিন্দনীয়

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, এডভোকেট

বিগত ১৮ সেপ্টেম্বরের দেশের প্রায় সকল পত্রিকায় প্রধান সংবাদ-শিরোনাম ছিল ফৌজদারী কার্যবিধির, ১৮৯৮ এর ১২(১) ধারা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ৬০ দিনের জন্য নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংক্রান্ত। আমি যা বুঝি না তা নিয়ে কথা বলি না, কলামও লিখি না। আমি বিগত ৪৬ বছর ব্যাপী ফৌজদারী আইন ও অপরাধ বিষয়ক উকালতি পেশায় নিয়োজিত আছি বিধায় বিষয়টি আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আওতাধীন। ১৮৯৮ সাল থেকে চালু হওয়া অধুনা সংশোধিত ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে তিন ধরনের ম্যাজিষ্ট্রেট আছেন। ১০ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট, ১১ ধারায় বিচার বিভাগীয় ম্যাজিষ্ট্রেট ও ১২ ধারায় বিশেষ ম্যাজিষ্ট্রেট। বিশেষ ম্যাজিষ্ট্রেট সরকারকর্তৃক নির্দেশিতমতে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সরকার ফৌজদারী কার্যবিধির নি¤œলিখিত ধারাসমূহ যথা- ম্যজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে সংঘটিত অপরাধ ৬৪ ধারা, ম্যাজিষ্ট্রেটকর্তৃক বা ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে গ্রেপ্তার ৬৫ ধারা, অধিক্ষেত্রের বাইরে কার্যকর করার জন্য প্রেরিত পরোয়ানা ৮৩ ধারা, অধিক্ষেত্রের বাইরে কার্যকর করার জন্য পুলিশ অফিসারের প্রতি নির্দেশিত পরোয়ানা ৮৪ ধারা, চিঠি ও টেলিগ্রাম সম্পর্কিত পদ্ধতি ৯৫(২) ধারা, বেআইনীভাবে আটক ব্যক্তির জন্য তল্লাশী পরোয়ানা ১০০ ধারা, ম্যাজিষ্ট্রেট তার উপস্থিতিতে তল্লাশীর আদেশ দিতে পারবেন ১০৫ ধারা, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুচলেকা নেওয়া ১০৭ ধারা, ভবঘুরে ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সদাচরণের জন্য মুচলেকা ১০৯ ধারা, অভ্যাসগত অপরাধীদের সদাচরণের জন্য মুচলেকা ১১০ ধারা, জামিনদারের অব্যাহতি ১২৬ ধারা, ম্যাজিষ্ট্রেট অথবা পুলিশ অফিসারের আদেশে সমাবেশ ছত্রভঙ্গ হবে ১২৭ ধারা, সমাবেশের জন্য অসামরিক শক্তি প্রয়োগ ১২৮ ধারা, জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার জন্য ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক আহূত বাহিনীর অধিনায়কের কর্তব্য ১৩০ ধারা, অবৈধ উৎপাত অপসারণের জন্য শর্ত সাপেক্ষ আদেশ ১৩৩ ধারা এবং অনুসন্ধানকালে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষমতা ১৪২ ধারাসমূহ সেনা বাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের দুই মাসের জন্য প্রদান করা হয়েছে।

সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট বিচার বিভাগীয় ম্যাজিষ্ট্রেটগণ সংশ্লিষ্ট এলাকার অপরাধ বিচারের জন্য আমলে নিতে ও বিচার করতে পারবেন। নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটগণ প্রশাসনিক বিষয় ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে অপরাধ প্রতিরোধমূলক বা নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ ও কার্যক্রম গ্রহন করতে পারবেন। ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইনেও ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আইনের তপশীলে উল্লেখিত কিছু নির্দিষ্ট অপরাধ তাৎক্ষণিক আমলে নিয়ে ঘটনাস্থলেই অপরাধীকে সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত শাস্তি দিয়ে সাজা পরোয়ানা লিখে অপরাধীকে সাথে সাথে কারাগারে প্রেরণ করতে পারেন। মোবাইল কোর্টের উক্ত দন্ডাদেশে সংক্ষুব্ধ ও অসন্তোষ্ট হলে দন্ডিত ব্যক্তি দন্ডাদেশের সহীমোহুরী নকল নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট আইনতঃ আপিল দায়ের করতে পারেন। আপিলে দন্ডিত কারাবাসী আসামী জামিনের প্রার্থনা করতে পারেন। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট আপিল নামজ্ঞুর করলে সেই নামজ্ঞুর আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৩৫/৪৩৯এ ধারায় দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা দায়ের করা যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জল হোসেন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লা গণপিটুনীতে নিহত হয়েছেন। তোফাজ্জলকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলা হচ্ছে, তাকে যারা পিটিয়ে খুন করেছে তারা কি মানসিকভাবে খুব সুস্থ? গত দুই মাসে গণপিটুনীতে দেশে ৩৫ জন মানুষ নিহত হয়েছেন বলে ২০ সেপ্টেম্বর কালেরকন্ঠ প্রথম পৃষ্টায় শিরোনাম করেছে। গণপিটুনীতে মানুষ হত্যাকে বলা হচ্ছে মব-জাস্টিস। মানুষ হত্যাকে কোন যুক্তিতেই জায়েজ করা বা বৈধতা দেওয়া যাবে না। এটা সম্পূর্ণ বেআইনী,দন্ডনীয় অপরাধ ও মব-ইনজাস্টিস। এটা মক-জাস্টিসের নামে ন্যায়বিচারকেই হত্যা করা।

দেশের সর্বত্র নিজেদের দাবী দাওয়া আদায় করার জন্য রাস্তাঘাট বন্ধ করে অন্য নাগরিকদের স্বাধীনতা,চলাচলের অধিকার,কাজ করার অধিকার ও মানবাধিকার অস্বীকার,লংঘন করে অবরোধ,মিছিল-মিটিং ইত্যাদি করে সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে অগ্নিসংযোগ ও মারামারিতে ৪ জন নাগরিক নিহত হয়েছেন। খাগড়াছড়িতে গনপিটুনীতে (মব জাস্টিস) মামুন নামের এক বাঙালি নিহত হওয়ার জেরে আয়োজিত প্রতিবাদ মিছিলে ইউপিডিএফ হামলা চালালে সংঘাতের সুত্রপাত হয় বলে জানা যায়। ঢাকার আশেপাশের গার্মেন্ট ফেক্টরী এলাকাগুলোতে বিভিন্ন দাবী ও অজুহাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে উৎপাদন ব্যাহত করা হচ্ছে। আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে সংঘটিত উল্লেখিত অপরাধমূলক কাজগুলো দ্রæত বন্ধ করে দেশের কলকারখানায় উৎপাদন ও আমদানী-রপ্তানী অব্যাহত এবং উদ্বিগ্ন দেশবাসীর মনে স্বস্তিবোধ ও নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনতে হলে মোবাইল কোর্টের ক্ষমতাসহ উল্লেখিত ফৌজদারী কার্যবিধির প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে ঘটনাস্থলেই তাৎক্ষণিক বিচার ও শাস্তি প্রদান করার কোন বিকল্প নাই। অগ্নিসংযোগ, দাঙ্গাহাঙ্গামা, গুরুতর জখম ও নরহত্যার মত জঘন্য অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদন্ড,যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা দশ/বিশ বছর মেয়াদের শাস্তির জন্য নিয়মিত মামলা রুজু,তদন্ত কার্য সমাপ্ত করা ও সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহন করে সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমাণ করে আসামীকে দন্ডিত করতে স্বাভাবিকভাবে অনেক বছর সময় দরকার হয়। মোবাইল কোর্ট আইনের তপশীলে থাকা প্রায় ৯৩টি আইনের বিভিন্ন ধারার অপরাধের বিচার ঘটনার সময় ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতাপ্রাপ্ত কমিশনপ্রাপ্ত সেনা-অফিসারগণ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে গিয়ে বিচার ও শাস্তি প্রদান করলে নিয়মিত মামলা চলতে আইনতঃ বাধা নাই।

১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের মাধ্যমে এ দেশে ব্রিটিশ আমলে পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি হয়। ১৯৪৩ সালের বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন অনুযায়ী ব্রিটিশ আমল,পাকিস্তান আমল,সামরিক শাসক আয়ুব খান,ইয়াহিয়া খান,জিয়াউর রহমান,এরশাদের আমলে এই পুলিশ বাহিনী পরিচালিত হয়েছে। কিন্ত বিগত ১৫ বছরে ঐতির্য্যবাহী পুলিশ বাহিনীকে ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে কাটা,ভিত্তিহীন গায়েবী মামলা দায়ের করে বিএনপি,জামাতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জেলভর্তি বা এলাকাছাড়া করে রাখা,বিনা পরোয়ানায় বিরোধী মতালম্বীদের তুলে নিয়ে গুম করা,ক্রস ফায়ারে হত্যা করা,আইজিপির মত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দলীয়করণ করে দুর্নীতি,লুটপাটে সিদ্ধহস্ত করা,ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান দমানোর জন্য নির্বিচারে গণহত্যা চালানোতে ব্যবহার করে সম্পূর্ণ পুলিশ বাহিনীর নৈতিকতা,মনোবল হারিয়ে নিজেরা গণরোশ ও গণপিটুনীর শিকার হয়ে থানা,পোশাক,অস্ত্র ফেলে নজিরবিহীনভাবে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যরা সকলে যেমন কাজে যোগদান করে নাই,তাদের হারিয়ে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদও সবগুলি উদ্ধার হয় নাই। পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি,বিশ্বাসযোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাস প্রায় শূর্ণ্যরে কোটায়। তা ফিরে আনতে,ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে। শত বছরের প্রচলিত নিয়ম ও আইন অনুযায়ী উচ্চ আদালত থেকে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের রায়,আদেশ, নির্দেশ ও পরোয়ানাদি কার্যকরী করা হয় পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে। প্রশাসন তথা সরকারের আদেশ/নির্দেশও প্রয়োগ ও কার্যকর করা হয় পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে। এখন পুলিশ বাহিনী পূর্ণ সক্ষমতাহীন, নৈতিক মনোবল হারা ও ভঙ্গুর।

দেশের বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন করে জনমনে স্বস্তির প্রত্যাশা ফিরিয়ে আনার জন্য কমিশনপ্রাপ্ত সেনা অফিসারদের ফৌজদারী কার্যবিধির উল্লেখিত ক্ষমতা প্রদান করাই বিকল্পহীন উত্তম পদক্ষেপ বলে ক্ষমতা দখল করার আগ্রহহীন শান্তিপ্রিয় দেশবাসী মনে করেন। আইন হাতে নেওয়ার প্রতিটি অপরাধের জন্য দ্রæত ঘটনাস্থলে গিয়ে মোবাইল কোর্ট আইনে ঘটনাস্থলেই বিচার করে শাস্তি প্রদান করে সাজা পরোয়ানামূলে কারাগারে প্রেরণ শুরু করলে ও তা ব্যাপক প্রচার করলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রæত উন্নতি হবে,ইনশাল্লাহ। কোন অজুহাতে অবহেলা বা উপেক্ষা না করে ছোট বড় সকল প্রকার অপরাধের বিচার ও শাস্তি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, তা সদাপ্রবঞ্চিত দেশবাসীর একান্ত প্রত্যাশা। ধর্ম যার যার নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার।

লেখক : একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা, সাবেক পিপি ও সভাপতি, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888