সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১১ পূর্বাহ্ন

২২ দিন পরে মায়ের কাছে ছোয়াদ

অপহরণ চক্রের প্রধান সহ গ্রেপ্তার ১৭

পুরাতন রোহিঙ্গাদের নিয়েই পারিবারিক অপহরণ চক্র

অপহরণ বাস্তবায়নকারিনারী ছিল ছোয়াদের বাড়ির গৃহকর্মী

নিজস্ব প্রতিবেদক : এই যে পুরোটাই একটি গল্প বা চলচ্চিত্রের কাহিনী। অপহরণ আর মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা নিয়েই প্রবাসির বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে ছিলেন এক সময়ের পুরাতন রোহিঙ্গা উন্মে সালমা। আর সেই সূত্র ধরেই ৯ মার্চ কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে অপহরণ করা হয়েছিল ৬ বছরের শিশু মাদ্রাসা ছাত্র ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহকে। আর ২২ দিনের মাথায় শনিবার (৩০ মার্চ) কুমিল্লার লালমাই এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে শিশুটিকে।

রবিবার শিশুটি অবশেষে ফিরেছে তার মায়ের কাছে। আর একই ঘটনায় গত ২২ দিনে দফায় দফায় গ্রেপ্তার ১৭ জনের কাছে মিলেছে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। আর সেই তথ্য শোনা মনে হবে এটি একটি চলচ্চিত্রের কাহিনী।

রবিবার দুপুরে টেকনাফ থানায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই অপহরণের বিস্তারিত বর্ণনা দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) মোহাম্মদ রাসেল ও টেকনাফ থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গণি।

অপহৃত শিশু ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহ টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের সৌদি প্রবাসি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ’র ছেলে। সে পূর্ব পানখালী এলাকার আবু হুরাইরা (রাঃ) মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। সংবাদ সম্মেলনে শিশুর মা নুরজাহান বেগমও উপস্থিত ছিলেন।

এ ঘটনায় কয়েক দফায় গ্রেপ্তার ১৭ জন হলেন, টেকনাফের মোচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নাগু ডাকাতের ছেলে আনোয়ার সাদেক (২১), তার পিতা মৃত আবদুর শুক্কুরের ছেলে নাগু ডাকাত (৫৫), মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী লায়লা বেগম (৫৫), মোহাম্মদ খানের স্ত্রী উম্মে সালমা (২৪), নাগু ডাকাতের ভাই মোহাম্মদ হাশেম (২৭), সৈয়দুল হকের স্ত্রী খাতিজাতুল খোবরা (৩৫), নাগু ডাকাতের স্ত্রী আয়েশা বেগম (৩২), সাদেকের স্ত্রী হোসনে আরা (২০), নাগু ডাকাতের অপর ছেলে রনি (১২), কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিরপাড়ায় বসবাসকারি পুরাতন রোহিঙ্গা জাফর আলমের ছেলে নাসির আলম (২৮), মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নের মাইস্যাঘোনা এলাকার মনছুর আলমের ছেলে সালামত উল্লাহ প্রকাশ সোনাইয়া (৪৫), একই ইউনিয়নের নয়াপাড়া এলাকার মৃত কালামিয়ার ছেলে জহির আহমেদ (৬৫), শামসুল আলমের ছেলে হাসমুল করিম তোহা (২০), সামিরাঘোনা এলাকার ফরিদুল আলমের ছেলে মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ (১৯), তার বাবা মৃত রহমত উল্লাহ ছেলে ফরিদুল আলম খান (৫২), সালামত উল্লাহর ছেলে মো. আমির হোসেন (২৪), শামসুল আলমের ছেলে তৌহিদুল ইসলাম তোহা (৩০)।

এরা সকলেই পরষ্পর আত্মীয় এবং রোহিঙ্গা জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উখিয়া সার্কেল) মোহাম্মদ রাসেল জানান, আনোয়ার সাদেকই মুলত এই অপহরণ চক্রের প্রধান হিসেবে কাজ করে আসছে। পরিবার সদস্য, আত্মীয়দের নিয়ে গঠিত অপহরণ চক্রের প্রদান সাদেকের পরিকল্পনায় উন্মে সালমা টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের সৌদি প্রবাসি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নিয়েছিল। যেখানে কিছু দিন কাজ করার পর ছেলে ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহর সাথে পরিচয় এবং সখ্যতা তৈরি করে। এর কিছু দিন পর উন্মে সালমা চলে গিয়ে অপহরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।

এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৯ মার্চ অপহরণ করা হয় শিশু ছোয়াদ বিন আব্দুল্লাহকে জানিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানান, গত ৯ মার্চ দুপুরে ক্লাস শেষে মাদ্রাসা ফেরার পথে ছোয়াদকে দুর্ঘটনায় মায়ের মাথা ফেটে গেছে এবং হাসপাতালে মাকে দেখতে যাওয়ার কথা বলে ছোয়াদকে অটোরিকশায় তুলে অপহরণ করেন উন্মে সালমা। ওইদিন সন্ধ্যায় ভূক্তভোগী শিশুর মা নুরজাহান বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় এজাহার দায়ের করেন। পুলিশ মামলাটি নথিভ‚ক্ত করে তদন্ত শুরু করে।

পুলিশ ঘটনাস্থল ও আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রাখে। ১০ মার্চ সন্ধ্যায় কক্সবাজার শহরের কেন্দ্রিয় বাস টার্মিনাল এলাকায় অভিযান চালিয়ে অটোরিকশাসহ চালক নাসির উদ্দিনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। অটোরিকশা চালকের স্বীকারোক্তি মতে গত ১২ মার্চ টেকনাফ উপজেলার মোচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ঘটনায় জড়িত সংঘবদ্ধ অপহরণকারি চক্রের উন্মে সালমা সহ আরও ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। এই ৫ জনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য নিয়েই অপহরণকারি পুরো চক্রটিকে শনাক্ত করা হয়ে ছিল বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ রাসেল।

ওসি মুহাম্মদ ওসমান গণি জানান, এরপর থেকে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রাখে। অভিযানে এক-একজনকে গ্রেপ্তারের পর আরও তথ্য আসতে শুরু করে। এর মধ্যে শিশুর নুরজাহান বেগমকে ফোন করে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এমনকি মুক্তিপন না দিলে শিশুটি হত্যা করার হুমকি প্রদান করে। মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে অপহৃত শিশুকে বিভিন্ন সময় নির্মমভাবে মারধর করে কান্নাকাটির শব্দ শোনায়। ফলে পুলিশ অভিযানের পাশাপাশি নানা কৌশলে এগিয়ে যেতে থাকে। অপহরণ চক্রের সদস্যরা শিশুটি নিয়ে একের পর এক স্থান পরিবর্তন শুরু করে।

ওসি জানান, টেকনাফ থেকে অপহরণের পর শিশুটিকে ঈদগাঁও এলাকায় রাখা হয়। ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়ার গহীন পাহাড়ে। যেখানে পুলিশ অভিযান টের পেয়ে শিশুটি নিয়ে যাওয়া হয় কুমিল্লার লালমাই এলাকার একটি ভাড়া বাসায়। এর মধ্যে মুক্তিপণের ৪ লাখ টাকা প্রদানের কৌশলে শনিবার দুপুরে কুমিল্লার লালমাই এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। এসয় মুক্তিপণের ৪ টাকা ফেরত আনা ছাড়াও অপহরণে ব্যবহৃত সিএনজি ও ৪টি মোবাইল ফোন উদ্ধার রয়েছে।

তিনি বলেন, আনোয়ার সাদেক, শাহীন, তোহা, নাগু ডাকাত, মধু, হোসনে আরা এবং তাদের পরিবারের সদ্যস্যরা অপহরণ চক্রের সক্রিয় সদস্য। এই অপহরণের ঘটনায় জড়িত অপহরণ চক্রের অন্যান্য সদস্যদের শনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গ্রেপ্তার আসামিদের আদালতে প্রেরণ করা হচ্ছে।

২২ দিন পর শিশুকে ফেরত পেয়ে অপহৃত শিশুর মা নুরজাহান বেগম সন্তোষ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, অপহরণ যে কোনভাবেই বন্ধ হওয়া জরুরি। পুলিশকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

পুলিশের তথ্য বলছে, গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১১৭ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫৯ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকিরা রোহিঙ্গা নাগরিক। অপহরণের পরিবারের তথ্য বলছে অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৫১ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

.coxsbazartimes.com

Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themesbcox1716222888