শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০০ পূর্বাহ্ন
বিগত ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির বার্ষিক নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ফলাফলও যথাসময়ে ঘোষিত হয়েছে। নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী কেউ নির্বাচন ও ফলাফল সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তুলেন নাই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিনিয়র এডভোকেট মুহাম্মদ বাকেরের নেতৃত্বে অন্যান্য কমিশনারবৃন্দ এডভোকেট মোহাম্মদ নুরুল হুদা, এডভোকেট মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম, এডভোকেট মোহাম্মদ ফেরদাউস, এডভোকেট মোহাম্মদ শফিউল হক, এডভোকেট মোস্তাক আহমদ-৪, এডভোকেট ফরিদ আহমদ, এডভোকেট নুর আহমদ-২, এডভোকেট আবু ছিদ্দিক ও এডভোকেট সিরাজ উল্লাহ অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রেখে একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনকে আইনজীবীরা ধন্যবাদ জানাচ্ছেন।
ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায় সভাপতি,সাধারণ সম্পাদকসহ ১৭টি পদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ পেয়েছে ১৪টি পদ এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ পেয়েছে একটি সহ-সভাপতি, দুইটি সদস্য পদসহ মোট ৩টি পদ। সরকারী দল সমর্থিত প্যানেলের এমন লজ্জাজনক পরাজয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে একজন জাসদ নেতা এমন হতাশাজনক ফলাফলের প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনের দাবী জানিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশে নজিরবিহীন উন্নয়নের সাথে কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির বর্ধিত বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন কোটি টাকার অধিক অনুদান দিয়েছিলেন বলে বহুল প্রচার আছে। নবনির্মিত সেই ভবন ভাগ্যবান আইনজীবীরা ব্যবহার করছেন। তারপরও কেন এমন পরাজয় সেই প্রশ্ন একজন দেশপ্রেমিক নেতার পক্ষে উত্থাপন করা মোটেও অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক নয়। কিছু দিন আগে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনেও সরকারী দল সমর্থিত প্যানেলের প্রায় একই ধরনের পরাজয় হয়েছে।
গত ৭জানুয়ারী অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৩০০ আসনের মধ্যে ২২৪ আসনে বিজয়ের পর আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে এই হতাশাজনক ফলাফল নিয়ে জনমনে শত প্রশ্ন যেমন আছে,শত ধরনের উত্তর ও মন্তব্যও শুনা যায়। সরকারী দলের স্থানীয় কতিপয় সুযোগ পাওয়া নেতাদের দুর্নীতি ও বেপরোয়া আচরণে সাধারণ আইনজীবীরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না করলেও চরম অসন্তোষ্ট ছিলেন। সরকারী দলের অনেক প্রার্থীদের অতি আত্মবিশ্বাস অনেক সময় ভোটারদের কাছে অতি আত্মঅহংকার বা অহমিকা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সরকারী প্রভাবমুক্ত নির্বাচনে তার প্রতিফলন পড়েছে। পরাজিত প্রার্থীদের পক্ষে অজুহাত হিসেবে বলা হচ্ছে ভোটের আগের দিন রাত্রে জামায়াত-বিএনপির পক্ষে প্রচুর টাকা খরচ করে ভোট ক্রয় করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে,সত্যিই কি ভোট ক্রয় করা হয়েছে? শুধু কি জামায়াত-বিএনপির পক্ষেই ভোট ক্রয় করা হয়েছে,সরকারী দলের পক্ষে ক্রয় করা হয় নাই? সব পক্ষ ভোট ক্রয় করলে দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও সরকারী দলের থেকে বিরোধী দলের ক্রয়ক্ষমতা এখনও বেশী রয়ে গেছে?
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে সাধারণ ভোটাররা উৎসাহ নিয়ে নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়া সুযোগ পান নাই অনেক বছর ধরে। তাই ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি আশংকাজনকভাবে কম ছিল। কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ২টি কেন্দ্রে মোট ৯২৭ জন ভোটারের মধ্যে ৮৭৭জন ভোটার উৎসবমূখর পরিবেশে র্নিভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন, অর্থাৎ ৯৪.৬০% ভোটার ভোট প্রদান করেছেন।
এই বারের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বেশী আলোচিত হচ্ছে আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টিকারী সর্বোচ্চ ৬২৭ ভোট পেয়ে সিনিয়র নির্বাহী সদস্য পদে নির্বাচিত ইকবালুর রশিদ আমিন সোহেলের নাম। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা। কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ও সভাপতি হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু বিগত ২০২৩ সালের নির্বাচনে সভাপতি পদে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। তিনি সভাপতি থাকার সময় একজন বিতর্কিত বিচারকের বিরুদ্ধে আইনজীবী সমিতির আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল এবং অনেক দিন বর্জনের পর তা কিছু শর্তে স্থগিত করা হয়েছিল। বর্তমানে অবসরে যাওয়া সেই বিচারক নিজেকে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থক দাবী করতেন এবং ঈদের জামাতে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেওয়ার সময় অপ্রাসঙ্গিকভাবে নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়ায় খুব সমালোচিত হয়েছিলেন। সেই বিচারক সাহেব ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে সোহেলকে ভোট না দেওয়ার অনুরোধসহ বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে সোহেলকে পরাজিত করা হয়েছিল বলে অধিকাংশ আইনজীবীদের বিশ্বাস। সোহেল বিচার বিক্রীর সাথে কোনভাবে জড়িত ছিলেন না বা সভাপতির পদ ব্যবহার করে জামিন বাণিজ্য করেন নাই। তিনি সততার সাথে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই সম্পর্কে সাধারণ আইনজীবীদের কোন সন্দেহ নাই। তাই তার সততা,যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সাধারণ আইনজীবী ও বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত বিবেকবান আইনজীবীরাও ভোট দিয়েছেন। তাই তিনি ৬২৭ ভোট পেয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন। সেই রেকর্ড ভবিষ্যতে কেউ ভঙ্গ করতে পারেন কিনা তার জন্য কয় বছর অপেক্ষা করতে হয় আল্লাহই জানেন। এতে প্রমাণিত হয়েছে সততার জন্য সাময়িক অসুবিধার সম্মুখিন হলেও সৎ ব্যক্তিদের দল মত নির্বিশেষে সকলেই পছন্দ করেন,সম্মান করেন। এই নির্বাচনে তা আবার প্রমাণ হল। সোহেল প্রদত্ত ৮৭৭ ভোটের মধ্যে একাই ৭১.৪৯% ভোট পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আওয়ামী লীগপন্থীদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন,মাথা উচু করেছেন। সুতরাং প্যানেলের ভরাডুবিতে হতাশ না হয়ে সোহেলের রেকর্ড সৃষ্টিকারী বিজয়কে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে ব্যবহার করে সরকারপন্থীদের উচিত সোহেলের মত নিরহংকার, সৎ, নির্লোভ, বিধি-বিধান মান্যকারী, দায়িত্বশীল ও যোগ্যতা অর্জন করে আগামী নির্বাচনে পুরো প্যানেল বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার জন্য এখন থেকে কাজ করা।
কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ কার্য নির্বাহী পরিষদের সকল সদস্যদের অভিনন্দন ও শুভকামনা। বর্তমানে কক্সবাজারে কর্মরত সকল বিচারক সৎ ও নিষ্ঠাবান হওয়ায় নতুন কমিটির কাজ করতে সুবিধা হবে। কার্য নির্বাহী পরিষদ কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির গঠনতন্ত্রের বিধান অনুসরণ করে আইনজীবীদের জন্য নির্ধারিত আচরণবিধি ও বিচারকদের জন্য অনুসরণীয় আচরণবিধি মান্য করে যাতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে আইনের প্রতিষ্ঠিত বিধান অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালিত হয় এবং বিচারপ্রার্থী জনগণকে ন্যায় বিচার প্রদান করা হয় সে সংক্রান্তে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। প্রয়োজনে বিধি বিধান অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহন করবেন, সে প্রত্যাশা করেন আইনজীবী সমাজ।
লেখক : একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা, সাবেক পিপি ও সাবেক সভাপতি, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply