শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৯ অপরাহ্ন
পাকিস্তান আমল থেকে বার্মা (এখন মিয়ানমার) বিশ্বের প্রধান চাউল উৎপাদনকারী ও রপ্তানীকারক দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। মিয়ানমার জ্বালানি তেল ও খাদ্যদ্রব্যে সব সময় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল বলে প্রচার ছিল। কিন্তু গত বছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে মিয়ানমারে জ্বালানি, ভোজ্যতেল ও খাদ্যদ্রব্যের মারাত্মক সংকট দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ থেকেই তা মিয়ানমারে পাচার হচ্ছে যা আমাদের আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরে আসে। এখন রাখাইন নামে পরিচিত আগের আরাকান রাজ্যে প্রচুর ধানচাল উৎপাদন হতো যা অধিকাংশই রোহিঙ্গারা উৎপাদন করতো। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ২০১৭ সালে প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে গণহত্যা, গণধর্ষণ ও বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়ে বাস্তÍুচ্যুৎ করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হলে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহন করে। ফলে ধানচাউল উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী ও স্বাধিকারের জন্য যুদ্ধরত আরকান আর্মি সহ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত তীব্র হয়ে উঠেছে। সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে একে একে সামরিক পোস্ট, স্থাপনা ও শহর বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দখল করে নিচ্ছে এবং মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে যাচ্ছে বা আত্মসমর্পণ করছে বলে নিয়মিত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদপত্রে।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করায় অভ্যন্তরীণ যোগযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। পশ্চিম আরাকানের (রাখাইন রাজ্য) বন্দর শহর মংডুর সঙ্গে জেলা ও বিভাগীয় শহর আকিয়াবের এবং রাজধানী ইয়াংগুনের যোগাযোগ সড়কও বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এসব কারণে জ্বালানি তেল,ভোজ্যতেল,চাউল ও খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্য প্রয়োজনী পণ্যসামগ্রীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। পশ্চিম আরাকানসহ আকিয়াব, ভুচিদং, রাশিদং ও মংডু এলাকায় নিত্যপণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী । এ সুযোগে কক্সবাজারের সুযোগসন্ধানী সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট মিয়ানমারে জ্বালানি তেল,ভোজ্যতেল,চাউলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাচার করছে। মংডু শহরে ৫০ কেজি চাইলের এক বস্তার দাম বাংলাদেশী মুদ্রায় ৯ হাজার টাকা অর্থাৎ প্রতি কেজি ১৮০ টাকা, প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৪৫০ টাকা, প্রতি লিটার অকটেনের দাম ১৬০০ টাকা, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১৪০০ টাকা। অথচ বাংলাদেশে প্রতি কেজি সাধারণ মানের চাউল ৬০ টাকা,প্রতি লিটার অকটেন ১৩৫ টাকা, ডিজেল ১১১ টাকা, সয়াবিন প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় বিক্রী হচ্ছে। এজন্য অতি লাভের আশায় বাংলাদেশ থেকে জ্বালানি,ভোজ্যতেল,চাউল মিয়ানমারে পাচার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এই দেশের পাচারকারীরা। মরার উপর খাড়ার ঘা আশ্রিত প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গা বিগত ছয় বছর ধরে তো আছেই।
পাচার রোধ করার লক্ষ্যে অনতি বিলম্বে ১৭ জানুয়ারী জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরানের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসনের বিশেষ সভা আহŸান করে নজরদারি বৃদ্ধিসহ পাচার বন্ধে দ্রæত ব্যবস্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরের দিন ১৮ জানুয়ারী কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ ইয়ামিন হোসেন এর নেতৃত্বে সাগরপথে অবৈধভাবে জ্বালানি তেল পাচারের বিরুদ্ধে এক অভিযানে শহরের বাকঁখালী নদীর মোহনায় লাইসেন্সবিহীন পেট্রোলিয়াম ব্যবসা পরিচালনার দায়ে ছয় প্রতিষ্ঠানকে ২ লক্ষ ১৮হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর মধ্যে শহরের নুনিয়াছড়া এলাকার লাইসেন্স ছাড়া বার্জ পরিচালনার দায়ে দুটি প্রতিষ্ঠানকে এক লক্ষ করে দুই লক্ষ টাকা পরিমানা করা হয়েছে। ডলার খরচ করে কেনা বাংলাদেশের জ্বালানি তেল কোন অবস্থাতেই মিয়ানমারে পাচার হতে দেওয়া যাবে না। এবার থেকে তেলের পাম্পগুলি কি পরিমাণ তেল কিনছে এবং পাম্প থেকে কারা কি পরিমাণ তেল কিনছে তার হিসাব রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষে।
কক্সবাজারের কমপক্ষে ২২টি পয়েন্ট ব্যবহার করে নৌকা ও ট্রলারে পাচার হচ্ছে এসব তেল ও পণ্য। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক,নুনিয়াছড়া,মাঝের ঘাট,খুরুস্কুল,চৌপলদন্ডী, কলাতলী,দরিয়ানগর,হিমছড়ি,ইনানী,সোনারপাড়া,টেকনাফের শাপলাপুর, লম্বরী, মহেষখালীয়াপাড়া, সাবরাং,শাহপরীরদ্বীপ,মহেষখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার সমুদ্র উপকুল ব্যবহার করে পাচার করে যাচ্ছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। যাদের একটি তালিকা ইতিমধ্যে তৈরী করেছে প্রশাসন। তালিকায় জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের ডিলার প্রতিষ্ঠানের মালিক,জনপ্রতিনিধি ও জেলেদের নাম এসেছে। মূল্যবান ডলার খরচ করে আমদানী করা তেল চোরাচালানীদের দ্বারা মিয়ানমারে পাচার বন্ধ করার দায়িত্ব শুধু র্যাব,বিজিবি,পুলিশ ও প্রশাসনের নয়,সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকের দায়িত্ব এ ব্যাপারে প্রশাসনকে সাহায্য করা। স্ব স্ব এলাকায় পাচার রোধে দৃশ্যমান ভুমিকা রাখা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়ার এখন উপযুক্ত সুযোগ ও শ্রেষ্ট সময়।
লেখক : একাধিক গ্রন্থের প্রণেতা, সাবেক পিপি ও সাবেক সভাপতি, কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply