বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৩ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল দিয়ে মিয়ানমারে জ্বালানি তেল অকেটন, ডিজেল, ভোজ্য তেল সয়াবিন পাচার আশংকাজনক হারে বেড়েছে। যার সাথে পাচার হচ্ছে পেঁয়াজ, রোশন, চাল, ডাল, মরিচ সহ নানা খাদ্য পণ্যও। গত ১ মাসে নানা উপকূল থেকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে মিয়ানমারে পাচারকালে ৭৬৩৬ লিটার অকেটন, ১৩৬ লিটার ডিজল ও ৩ হাজার ৭৫২ লিটার সয়াবিন তেল সহ ২৮ পাচারকারিকে আটক করা হয়েছে। এ পরিস্থিতি পাচার রোধে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন বিশেষ সভা করেছে।
বুধবার দুপরে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় জ্বালানি ও ভোজ্য তেল বিক্রিকারি প্রতিষ্ঠানকে সাপ্তহিক তালিকা তৈরি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে জমা প্রদান, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নজরধারী বৃদ্ধি সহ নানা সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরানের সভাপতিত্বে সভায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোষ্টগার্ড, জেলার ৩৫ টি পাম্প, ৩০ টি প্যাক পয়েন্ট ও ৮ টি বার্জ মালিকরা উপস্থিত ছিলেন।
আর এই সভার পর পরই বুধবার বিকাল ৪ টায় টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ অভিযান পরিচালনা করে ২৫টি ড্রামে মোট ১৪১৫ লিটার অকটেন, ৪০ কেজি পেঁয়াজ, ৩১ কেজি রসুন, ৩৬ কেজি আদা উদ্ধার সহ পাচারকারী চক্রের ২ সদস্যকে আটক করেছে র্যাব-১৫।
এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের সমুদ্র উপক‚ল থেকে দেড় হাজার লিটার জ্বালানি তেল অকটেন সহ মো. হারুন নামে এক পাচারকারীকে আটক করেছে পুলিশ।
গত ২৫ ডিসেম্বর কোস্টগার্ড সদস্যরা অভিযান চালিয়ে টেকনাফের লম্বরি ঘাট থেকে ১৫ বস্তা শুকনা মরিচ, ৪০ বস্তা পেঁয়াজ, এক বস্তা তামাক পাতা, ৩ বস্তা আয়োডিন যুক্ত লবণ, এক হাজার ৮২১ লিটার অকটেন, ৩ হাজার ৭৫২ লিটার সয়াবিন তেল, ১৩৬ লিটার ডিজেলসহ ১৯ জন পাচারকারীকে আটক করে।
গত ১৩ জানুয়ারী কক্সবাজারের দরিয়ানগর এলাকা দিয়ে পাচারকালে ৬৯টি ড্রামভর্তি দুই হাজার ৯০০ লিটার অকটেন জব্দ করেছে র্যাব। এ পাচারের দায়ে ৬ জনকে আটক করা হয়।
সর্বশেষ বুধবার আটক ২ জন হলেন, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ মারে পাড়ার আমান উল্লাহর ছেলে ফয়েজ উল্লাহ (২২) ও একই এলাকার আবদুল গফুরের ছেলে আব্দুল্লাহ (২০)।
র্যাব ১৫ এর সিনিয়র সহকারি পরিচালক (আইন ও গণমাধ্যম) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু সালাম চৌধুরী জানিয়েছেন, কক্সবাজার জেলার সমুদ্রের বিভিন্ন চ্যানেল ব্যবহার করে কতিপয় চোরাকারবারী জ্বালানী তৈল অকটেনসহ বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অবৈধভাবে চোরাচাইপথে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচারের খবর পেয়ে র্যাব অভিযান চালায়। অভিযানে বিকাল ৪ টার দিকে শাহপরীর দ্বীপ মাঝের পাড়া এলাকার ডাঙ্গরপাড়া-মাঝেরপাড়া সড়কের পশ্চিম পাশে র্যাবের আভিযানিক দলের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তিনজন ব্যক্তি তাদের হেফাজতে থাকা অকটেন ভর্তি প্লাস্টিকের ড্রামসহ অন্যান্য জিনিসপত্র রেখে পালানোর চেষ্টাকালে দুইজনকে আটক করা হয়। অপরজন পালিয়ে যায়। যেখানে ২৫টি ড্রামে ১৪১৫ লিটার অকটেন, ৪০ কেজি পেঁয়াজ, ৩১ কেজি রসুন, ৩৬ কেজি আদা উদ্ধার এবং ৩টি সীমসহ ১টি বাটন ও ০১টি স্মার্ট ফোন উদ্ধার করা হয়।
তিনি জানান, এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা করে আটকদের টেকনাফ থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি জ্বালানি ও ভোজ্য তেল পাচার আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি সংক্রান্ত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি প্রতিবেদন হাতে আসার পর বুধবার দুপুরে পাচার রোধে এই বিশেষ সভাটির আয়োজন করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য জানিয়েছে, ডিসেম্বরের মাঝা-মাঝি সময় থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি অভিযানের পর মিয়ানমারের জ্বালানি-ভোজ্য তেল ও খাদ্য পণ্য পাচারের বিষয়টি নজরে আসে।
এসব অভিযানের পর আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তৎপর হয়ে উঠে। যেখানে তৈরি হওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলমান সংঘাত তীব্র হয়ে উঠেছে। যার কারণে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমনকি পশ্চিম আরাকানের (রাখাইন রাজ্য) বন্দর শহর মংডুর সঙ্গে জেলা ও বিভাগীয় শহর আকিয়াব এবং রাজধানী ইয়াংগুনের যোগাযোগ রক্ষাকারী সড়কও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এসব কারণে পণ্য সামগ্রী সংকট দেখা দিয়েছে। পশ্চিম আরাকানসহ আকিয়াব, ভুচিদং, রাশিদং ও মংডু এলাকায় নিত্যপণ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। এ সুযোগে কক্সবাজারের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট মিয়ানমারে পাচারের তৎপরতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের মংডু শহরে ৫০ কেজির এক বস্তা চালের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় এখন ৮৯২৮ টাকা বা প্রতি কেজির দাম ১৭৮ টাকা। প্রতি লিটার ভোজ্য তেল সয়াবিনের দাম ১৪৫০ টাকা, প্রতি লিটার অকটেনের দাম ১৬০০ টাকা, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১৪০০ টাকা। অথচ বাংলাদেশে প্রতি লিটার অকটেন ১৩৫ টাকা ও ডিজেল ১১১ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। আর সায়বিন প্রতি লিটার ১৮০ টাকা। যার জন্য বাংলাদেশ থেকে জ্বালানি ও ভোজ্য তেল কিনে মিয়ানমারে পাচারে অধিক মুনাফা পাচ্ছে পাচারকারীরা।
কক্সবাজারের কমপক্ষে ২২ টি পয়েন্টকে ব্যবহার করে নৌকা ও ট্রলার যোগে পাচার হচ্ছে এসব তেল ও পণ্য। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক, নুনিয়ারছড়া, মাঝের ঘাট, খুরুশকুল, চৌফদন্ডী, কলাতলী, দরিয়ানগর, হিমছড়ি, ইনানী, সোনাপাড়া, টেকনাফের শাপলাপুর, লম্বরী, মহেশখালীয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার সমুদ্র উপক‚ল ব্যবহার করে তা পাচার করে যাচ্ছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। যাদের একটি তালিকাও ইতিমধ্যে তৈরি করেছে প্রশাসন। তালিকায় জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের ডিলার প্রতিষ্ঠানের মালিক, জনপ্রতিনিধি সহ জেলেদের মিলে সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে নাম এসেছে।
যার প্রেক্ষিতে বুধবার দুপরে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরানের সভাপতিত্বে সভায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোষ্টগার্ড, জেলার ৩৫ টি পাম্প, ৩০ টি প্যাক পয়েন্ট ও ৮ টি বার্জ মালিকদের উপস্থিতিতে পাচার রোধে বিশেষ সভা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেনএ
তিনি জানান, অনুষ্ঠিত সভায় জ্বালানি ও ভোজ্য তেল বিক্রিকারি প্রতিষ্ঠানকে সাপ্তাহিক তালিকা তৈরি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে জমা প্রদান। কে ক্রয় করছেন, কত পরিমাণ ক্রয় করছেন, কতদিন পর ক্রয় করছেন তালিকায় তা উল্লেখ থাকবে। যে তালিকাটি উপজেলা প্রশাসন জেলা প্রশাসন বরাবরে পাঠাবেন। তালিকায় কোন প্রকার অসঙ্গতি থাকলে তার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপকূল পয়েন্টে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নজরধারী বৃদ্ধি সহ নানা সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply