শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৪ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : ঝিনুকের আদলে তৈরি এশিয়ার সর্ব বৃহৎ আইকনিক রেল স্টেশন কক্সবাজারে পৌঁছে গেল স্বপ্নের প্রথম ট্রেন। রবিবার সন্ধ্যা ৬ টা ২০ মিনিটের দিকে আলোকময় হয়ে হুইসেল বাজাতে বাজাতে পৌঁছে যায় এই ট্রেন। যে ট্রেনটি রবিবার সকাল ৯ টা ২ মিনিটে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে কক্সবাজার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিল।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র শহর কক্সবাজারে স্বপ্নের এই রেল লাইন উদ্বোধন হচ্ছে ১১ নভেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করবেন। মুলত উদ্বোধনের আগে প্রকল্পটি রেল চলাচলের উপযোগি কিনা তা দেখতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ট্রেনটি যাত্রা। স্বপ্নের এই ট্রেন পৌঁছার দৃশ্য দেখতে রবিবার বিকাল থেকে স্টেশনে জড়ো হতে থাকে বিপুল সংখ্যক মানুষ। আর সেই মানুষের অভিবাদন আর উল্লাসে মুখরিত পরিবেশে পৌঁছে যায় ট্রেনটি।
রবিবার (০৫ নভেম্বর) সকাল চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে আটটি বগি নিয়ে ২৯২৫ সিরিজের ইঞ্জিন নিয়ে জিআইবিআর স্পেশাল ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে। সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) রুহুল কাদের আজাদের নেতৃত্বে ১৪৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথের যাত্রা শুরু হয়। চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ষোলশহর স্টেশন, জ্বালানিহাট রেলস্টেশন, সংস্কার করা শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু পার হবে ট্রেনটি। এরপর বোয়ালখালী, পটিয়া, চন্দনাইশ এলাকা পার হয়ে যাবে দোহাজারী স্টেশনে। সেখান (দোহাজারী) থেকেই মূলত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে।
দোহাজারী স্টেশন থেকে স্বপ্নের এই ট্রেন যাবে সাতকানিয়া, লোহাগাড়ার চুনতি অভয়ারণ্য হয়ে চকরিয়া; চকরিয়া থেকে রামু হয়ে কক্সবাজারে নবনির্মিত আইকনিক স্টেশনে পৌঁছে সন্ধ্যা ৬ টা ২০ মিনিটে।
জিআইবিআর এর এই পরিদর্শন দলের সঙ্গে আরো আছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম মো. নাজমুল ইসলাম, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবু জাফর মিঞা, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মো. আবুল কালাম চৌধুরীসহ রেলওয়ের উর্ধতন কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে দেখা যায়, নির্বিঘেœ ট্রেন চলাচল করছে। কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে যখন ট্রেন পৌঁছে। তখন ট্রেনের গতি কমিয়ে ফেলা হয়। পরে কালুরঘাট সেতু পার হওয়ার পর যথারীতি ট্রেনের গতিবেগ বেড়ে যায়। পরে বোয়ালখালীর বেঙ্গুরা, পটিয়া স্টেশন, চন্দনাইশ পার হয়ে ট্রেন পৌঁছে নবনির্মিত দোহাজারী স্টেশনে। মূলত দোহাজারী স্টেশন থেকেই কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েলগেজ নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। এই স্টেশনটির নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। কিছুদূর পর গিয়ে পৌঁছি সাতকানিয়ার কেওচিয়া এলাকায় পৌঁছে। যেখানে সাম্প্রতিক বন্যায় প্রায় দুই কিলোমিটার অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে সেই ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন সংস্কার করে রেল কর্তৃপক্ষ।
পরে সাতকানিয়া সড়ক ক্রস করে রেলপথ ছুটে যায় কক্সবাজারের পথে। পথিমধ্যে সাতকানিয়া পেরিয়ে লোহাগাড়ার চুনতি অভয়ারণ্য পার হতে থাকে ট্রেন। পরক্ষণেই পাহাড় কেটে নির্মাণ করা রেলপথ যেতে যেতে চোখে পড়ে হাতি চলাচলের জন্য নির্মাণ করা আন্ডারপাসের। পাহাড় ঘেরা চিরসবুজ এই রেলপথের চুনতি পেরিয়ে হারবাং স্টেশন, ডুলাহাজারা স্টেশন, ইসলামাবাদ স্টেশন ও রামু স্টেশনে পৌঁছে। এই রেলপথ ধরে ট্রেন যাওয়ার সময় পথিমধ্যে হাজার হাজার স্থানীয়রা ট্রেনকে উষ্ণ অভিনন্দন জানান।
আটটি বগি নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলক যাত্রার এই ট্রেনটি চালান লোকোমাস্টার মো. মাহফুজুর রহমান এবং সহকারী লোকোমাস্টার রুখন মিয়া। এছাড়াও ট্রেনে একাধিক গার্ড, রেলওয়ে পুলিশ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা (আরএনবি) দায়িত্ব পালন করছেন।
ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে যাওয়া কক্সবাজারে প্রথম ট্রেন নিয়ে যাওয়া লোকোমাস্টার মো. মাহফুজুর রহমানের কাছে অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, খুব ভাল লাগছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে যাওয়া পরীক্ষামূলক ট্রেনটি আমি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তবে এ অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। ২০১৪ সাল থেকে আমি লোকো মাস্টার হিসেবে ট্রেন চালাচ্ছি। সম্প্রতি আখাউড়া আগরতলা রেলপথের প্রথম ট্রেনটিও আমি চালিয়েছি। সত্যিই ভাল লাগছে।
প্রত্যেক স্টেশনে স্টেশনে জিআইবিআর প্রধান পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটের দিকে ট্রেনটি কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনে পৌঁছায়। নবনির্মিত রেলপথ, ব্রিজ ও স্টেশনগুলো জিআইবিআর প্রধান পরিদর্শনের কারণে এ দীর্ঘ সময় লেগেছে বলে জানিয়েছেন ট্রেনে থাকা আরেক লোকোমাস্টার সাজু কুমার দাশ। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টার মতো। যেহেতু এখনো নতুন রেলপথ। তাই ঘন্টায় ৪০-৪৫ কিলোমিটার গতিবেগে ট্রেন চালানো হয়েছে। সব ঠিকঠাক হয়ে গেলে ক্রমান্বয়ে ঘন্টায় ৬০, ৭০ ও ৮০ কিলোমিটার গতিবেগে ট্রেন চালানো হবে। তখন ট্রেন নির্ধারিত সময়েই পৌঁছাবে।
এদিকে, পরীক্ষামূলক ট্রেন যাত্রা ও পরিদর্শন শুরুর আগে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে জিআইবিআর প্রধান রুহুল কাদের আজাদ বলেন, আমরা নবনির্মিত দোহাজারী কক্সবাজার রেলপথ পরিদর্শনের জন্য যাচ্ছি। আমরা নবনির্মিত রেললাইনের ট্র্যাক, স্টেশন বিল্ডিং, সিগন্যালিং, ব্রিজ, কালভার্ট, আন্ডারপাস সরেজমিনে আমরা পরিদর্শন করবো। আমাদের সঙ্গে সিগন্যালিং, ইলেকট্রিক্যাল, রেল ট্র্যাকসহ সমস্ত বিভাগের প্রকৌশলীরা আছেন। আমার কাজ হল রেল ট্র্যাক থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা। দেখে আমি ঢাকায় গিয়ে রিপোর্ট দিবো।’
এসময় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আজকের এই যাত্রা ট্রায়াল নয়। এটি আমাদের রুটিন কাজ। জিআইবিআর প্রধানের পরিদর্শন। এখানে আমাদের জিআইবিআর প্রধানসহ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রত্যেক বিভাগের প্রধানরা আছেন। জিআইবিআর প্রধানের সঙ্গে আমরাও যাচ্ছি। কালুরঘাট সেতুসহ দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেলপথ পরিদর্শন করা হবে। এই রেলপথ পরিদর্শনকালে জিআইবিআর সেখানে কোন ত্রুটি আছে কিনা দেখবেন। ইন্টারলকিং সিগন্যালিং ব্যবস্থা, প্লার্টফর্ম উঁচু সঠিক কিনা, কালভার্ট, লেভেল ক্রসিং গেট এসব দেখবেন। পরে রেলের পরিদর্শন অধিদফতরের কর্মকর্তারা সার্টিফাই করবেন। এরপর ট্রেন চলাচল করবে।
এর আগে শনিবার (০৪ নভেম্বর) ৯২ বছরের পুরনো কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলের জন্য একাধিকবার ট্রায়াল রান করে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল বিভাগ। এদিন ২২০০ সিরিজ (ওজন ৫০-৫৫ টন), ২৯০০ সিরিজ (ওজন ৭০-৭৫ টন) ও ৩০০০ সিরিজের (ওজন ৮৫-৯০টন) ইঞ্জিন দিয়ে এই ট্রায়াল রান করা হয়।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞা বলেন, ‘কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে এখন ট্রেন চলাচলে আর কোন বাঁধা নাই। এখন স্বপ্নের ট্রেন যাবে পর্যটন নগরী কক্সবাজার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে নতুন জেলা হিসেবে যুক্ত হবে কক্সবাজার।
বুয়েটের ত্রুটি সারিয়ে তোলা প্রসঙ্গে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম গত তিন মাস ধরে প্রায় শতবর্ষী এই কালুরঘাট সেতুতে সংস্কারকাজ করেছে। বৃহস্পতিবার সামান্য কিছু কাজ বাকি ছিল। পূর্বে কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে ১০ টনের এক্সেল লোডে ট্রেন চলাচল করতো। এখন বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের তত্ত্বাবধানে সংস্কারের পর কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে ১৫ টন এক্সেল লোডে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। আমরা ইতোমধ্যে তিন হাজার সিরিজের (৯০ টন ওজন) ইঞ্জিন দিয়ে ট্রায়ালও করেছি। এখন এই ইঞ্চিনের সঙ্গে ৫০টি কোচ লাগালেও আর কোন সমস্যা হবে না।’
এদিকে, আগামী ১১ নভেম্বর নবনির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. সুবক্তগীন বলেন, ‘দোহাজারী-কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথটি আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। আপাতত ট্রায়াল রান হবে না। জিআইবিআর প্রধানের নেতৃত্বে নতুন রেলপথটি পরিদর্শনে যাচ্ছেন আজ। তারা কোন ত্রুটি আছে কিনা তা যাছাই বাছাই করবেন।’
প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মো. আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যে প্রকল্পের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। প্রকল্পের অধীনে ১০২ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসানো হয়েছে। দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত এবং চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ এবং আন্ডারপাসসহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। কক্সবাজারে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক স্টেশনে নির্মাণকাজও শেষ। কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনসহ নয়টি স্টেশনের নির্মাণকাজ একদম শেষ পর্যায়ে। এছাড়াও আন্ডারপাসের ওপর দিয়ে হাতি চলাচলের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রকল্পের নথির তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালে ৬ জুলাই দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। পরে ২০১১ সালের ০৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মেগা প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। মেগা প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। পরবর্তীতে অর্থায়ন সংক্রান্ত জটিলতায় বেশ কিছুদিন প্রকল্পটি থমকে থাকার পর ২০১৫ সালে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং ওই বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্ন্তজাতিক দরপত্র আহবান করা হয়। দোহাজারি-চকরিয়া এবং চকরিয়া-কক্সবাজার (লট-১ ও লট-২) এই দুই লটে চীনা প্রতিষ্ঠান সিআরসি (চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন) ও দেশীয় তমা কনসট্র্যাকসন্স কোম্পানি ২৬৮৮ কোটি টাকা এবং চীনা প্রতিষ্ঠান সিসিইসসিসি ও দেশীয় ম্যাক্স কনসট্র্যাকসন্স ৩৫০২ কোটি টাকায় যথাক্রমে : এক ও দুই নম্বর লটের কাজ পায়। পরবর্তীতে ঠিকাদার নিয়োগের পর ২০১৭ সালে এই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply