শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৪ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : কক্সবাজার উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূণিঝড় ‘মোখা’। ইতিমধ্যে কক্সবাজার উপক‚লে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর মধ্যে কক্সবাজারের আশ্রয় কেন্দ্রে ঝুঁকির্পর্ণ মানুষ আসতে শুরু করেছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, জেলার ৫৭৬ টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৭ হাজারের বেশি মানুষ এখন আশ্রয় নিয়েছে। কক্সবাজার শহরের নিকটবর্তী উপক‚লীয় এলাকার লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেয়ার দৃশ্যও দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, কক্সবাজার জেলার সাড়ে ২৮ লাখ মানুষের ১০ লাখের বাস উপকূলে। স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের মতে, আশ্রয়কেন্দ্র গুলোর কোনোটির দরজা, জানালা নেই। শৌচাগারের অবস্থাও নাজুক। ভাঙা সিঁড়ি কিংবা পলেস্তার খসে পড়ছে। এগুলো সন্ধ্যা নামলে মাদকসেবী, অপরাধীদের আস্তানায় পরিণত হয়। কিন্তু সাগরে দুর্যোগের সৃষ্টি হলে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় তোড়জোড় শুরু করে প্রশাসন।
কক্সবাজার জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের তথ্য মতে, উপকূলীয় অঞ্চলে ৫৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্রর প্রতিটিতে গড়ে ৯০০ মানুষ আশ্রয় নিতে পারেন। সেই হিসেবে ৫৭৬টির ধারণ ক্ষমতা ৫ লক্ষ ১৮ হাজার ৪শ জন।
এসব আশ্রয়কেন্দ্র অপর্যাপ্ত বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা’র) কুতুবদিয়া উপজেলার সভাপতি এম. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলার বেশিরভাই আশ্রয়কেন্দ্রই জরাজীর্ণ। মুজিবকিল্লাগুলোর নিচ থেকে বালি-মাটি সরে গিয়ে পতিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে স্কুল, চিকিৎসা কেন্দ্র, কিন্ডার গার্টেন ভরপুর। তার ওপর আসবাবপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জামের চাপ থাকে। ফলে আশ্রয়ের চেয়ে দুর্ভোগ বাড়ে মানুষের।’
বড়ঘোপ ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, ‘আমার এলাকায় চারটি বøক নিয়ে একটি ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের সাড়ে ৭ হাজার মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে একটি। জনসংখ্যার বিচারে এটি পর্যাপ্ত নয়।’
আবুল কালাম বলেন, ‘আমরা জেলে পল্লীর বাসিন্দা। নিষেধাজ্ঞার এক নোটিশেই কূলে ফিরি, তেমনি দুর্যোগের এক সাইরেনে আশ্রয়কেন্দ্রে ভীড় জমাই। তবে জায়গার অভাবে মানুষ কুতুবদিয়া উপজেলা সদরের দিকে ছুটে লোকজন।’
মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ির বাসিন্দা আবদুর রহমান রিটন বলেন, ‘এখানকার নয়াপাড়া, সাইরার ডেইল, ষাইটপাড়ায় ১০ হাজার মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নেই। মানুষ দূর্যোগের কবলে পড়লে আশ্রয় নিতে আত্মীয়ের বাড়িতে ছুটেন।’
স্থানীয় ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সরওয়ার কামাল বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে সাড়ে ৬ হাজার মানুষের জন্য তিনটি সাইক্লোন শেল্টার থাকলেও মাইজপাড়া এবং ফুলজানমুরা এলাকার দুটি ঝুঁকিপূর্ণ। বাকী একটিতে মাত্র ১২০ জন মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। ঘূর্ণিঝড় উঠলে এখানকার মানুষ আত্মীয় স্বজনের বাসাবাড়িতে চলে যায়।’
পার্শ্ববর্তী ধলঘাটা ইউনিয়নের নাসির মোহাম্মদ ডেইল গ্রামের আবদুল মোনাফ বলেন, ‘দুর্যোগের সংকেত পড়লেই পরিবার-পরিজন নিয়ে পাশের কালারমারছড়া ইউনিয়নের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। এলাকার আশপাশে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের অবস্থা ভালো নয়।’
কক্সবাজার সদরের উত্তর গোলাতলীর বাসিন্দা সাইফ উদ্দিন জানান, ‘এখানকার আড়াই হাজার মানুষের জন্য একটি মাত্র আশ্রয়কেন্দ্র আছে। কিছুদিন আগে স্থানীয়রা দেড় লক্ষ টাকা খরচে সেটি সংস্কার করে। তবে এই আশ্রয়কেন্দ্রে মাত্র দুইশো মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। বাকীরা ছুটেন দেড় কিলোমিটার দূরের লোকালয়ে।’
সাইফুদ্দিন বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দারা মিলে ২০১৮ সালে আরেকটি আশ্রয় কেন্দ্রর জন্য সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন জানাই, কিন্তু আজ পর্যন্ত সাড়া পাইনি।’
চকরিয়ার উপকূলীয় বদরখালী ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রুবেল মিয়া বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের একমাত্র মগনামা পাড়ার আশ্রয়কেন্দ্রটি একেবারে জরাজীর্ণ। মানুষের ধারণক্ষমতার জন্য এটি পর্যাপ্তও নয়। সংযোগ সড়কের অবস্থাও বেহাল।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কক্সবাজার রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এক কর্মকর্তা জানান, ‘১৯৯০-৯১ সালে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে উপকূলীয় অঞ্চলে ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে সরকার। সেগুলোর বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক। এর মধ্যে ২০টির কোনোটির দরজা, জানালা কিংবা সিঁড়ি নেই। কোনো ভবনের পলেস্তার খসে পড়েছে।’
এ ব্যাপারে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কিছু কিছু আশ্রয়কেন্দ্র জরাজীর্ণ অবস্থায় বিষয়টি সত্য। তবে ২০২১-২২ সালে বিশ্বখাদ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম কুতুবদিয়ায় ১০টি, পেকুয়ায় ১০টি ও মহেশখালীতে ১০টিসহ ৭৩টি স্কুল-কাম সাইক্লোন শেল্টার সংস্কার করেছে।’
‘এছাড়া বেসরকারি একটি সংস্থা আরো ৯৬টি আশ্রয় কেন্দ্র সংস্কার করে উপযোগী করে তুলেছে। পাশাপাশি দুর্যোগ সহনশীল ১৯টি নতুন সাইক্লোন শেল্টার ও ছয়টি মুজিবকিল্লা নির্মাণাধীন,’ বলেন এই কর্মকর্তা।
এদিকে, মহেশখালীর উপদ্বীপ ধলঘাটা। এ ইউনিয়নে ২০ হাজার মানুষের জন্য ১২টি স্কুল-কাম আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে সম্প্রতি ছয়টি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। দুটির সংস্কার চলমান।
ধলঘাটার ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, ‘দক্ষিণ মুহুরীঘোনা নুরানী মাদ্রাসা আশ্রয়কেন্দ্রটি ছয় বছর ধরে দখলে রেখেছেন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আহসান উল্লাহ বাচ্চু ও তার ভাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ। অপরদিকে সাপমারার ডেইল সিসিডিবি আশ্রয়কেন্দ্রটি পাঁচ বছর ধরে প্রভাবশালী ছৈয়দ আকববের দখলে। তাদের দু’বার উচ্ছেদ করা হলেও পুনরায় দখলে নিয়েছেন তারা। কিন্তু প্রশাসন নিরব।’
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত আহসান উল্লাহ বলেন, ‘আমার কাছে এটি চাবি থাকলেও দখলে থাকার বিষয়টি মিথ্যা। আমি পরিবার-পরিজন স্থায়ীভাবে কক্সবাজারে ‘স্যাটেল’।’
তবে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এর এটি তাঁকে উচ্ছেদ করে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের জন্য খুলে দেয়া হয়েছিল। যদি পূনরায় দখলে নেন উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়া হবে।’
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘স্থানীয় প্রভাবশালী দ্বারা আশ্রয়কেন্দ্র দখলে থাকার বিষয়টি নজরে এসেছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply