বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩০ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : সাগরে ট্রলার ডুবিতে স্বামী সাইফুল ইসলামকে হারিয়ে ঘরের সামনে আহাজারি করছেন স্ত্রী পারভিন আক্তার। তাকে শান্তনা দিয়ে কান্না থামাতে গিয়ে নিজেই কেঁদে দিচ্ছেন শাশুড়ি নাছিমা খাতুন। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাদের কান্না। আর পাড়া-প্রতিবেশীরাও তাদের কান্না দেখে চোখ দিয়ে পানি ফেলছেন। আর সাইফুল ইসলামের পিতা গুরা মিয়াও ছেলের শোকে পাগল প্রায়।
রোববার (২১ আগস্ট) দুপুরে কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুলের পূর্ব হামজার ডেইলের কদমতলি গ্রাম দেখা যায় এ দৃশ্য।
সাগরে ট্রলার ডুবিতে মারা যাওয়া জেলে সাইফুল ইসলামের স্ত্রী পারভিন আক্তার বলেন, ট্রলার ডুবিতে স্বামী হারিয়ে এখন খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। একে তো মা-বাবা নেই, তার ওপর ৪ বছরের এক কন্যা শিশু ও পেটে ৫ মাসের সন্তান রেখে স্বামী সাইফুল ট্রলার ডুবিতে মারা গেছে। ২টি এনজিওর কাছ থেকে কিস্তিতে টাকা নেয়ার পাশাপাশি সুদে মানুষের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছি।এখন কোন দিকে যাব কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।
“এখন আমি সন্তানদের নিয়ে কোন দিকে যাব, কিভাবে স্বামী ধার-দেনা পরিশোধ করব। কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। একে তো মা-বাবা নেই এতিম, স্বামীও হারালাম। বৃদ্ধ শশুর-শাশুড়ি নিয়ে কিভাবে সংসার চালাব? স্বামী তো অঢেল টাকা রেখে যায়নি, বরং ২ লাখ টাকার বেশি ধার-দেনা রেখে গেছে বলেও জানায় পারভিন।”
শুধু পারভিন আক্তার নন; পূর্ব হামজার ডেইলের কদমতলি গ্রামে ট্রলার ডুবিতে মারা যাওয়া ৭ জেলে পরিবারের একই অবস্থায়। প্রতিটি পরিবারই ধার-দেনায় জর্জরিত। পরিবারের একমাত্র উপার্জন করা ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশেহারা স্বজনরা।
মারা যাওয়া জেলে সাইফুলের মা নাছিমা খাতুন বলেন, আমরা তো ধার-দেনা নিয়ে কষ্টে দিন পার করি। ছেলে সাইফুল সাগরে গিয়ে মাছ ধরে আসলে টাকা পেলে সংসারটা কোন রকম চলে। কিন্তু এখন কে সংসার চালাবে। ছেলে বউ, নাতী ও আমরা বৃদ্ধ দুইজন কি করব। কোন পথ খুঁজে পাচ্ছি না। কিভাবে ধার-দেনা পরিশোধ আর কিভাবে সংসার চলবে?
ট্রলার ডুবিতে মহেশখালী চ্যানেলে রোববার সকালে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার জেলে আবছারের মরদেহ। পরে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কদমতলি গ্রামে তার বাড়িতে। মরদেহের সামনে আহাজারি করছেন আবছারের মা, বোন, স্ত্রী ও সন্তানরা।
মারা যাওয়া আবছারের বোন রাশেদা বেগম বলেন, আবছারই পুরো সংসার চালাতো। এখন সে ট্রলার ডুবিতে মারা গেছে। এই সংসার কে চালাবে? ছোট ছোট দুই সন্তান এখন কি করবে?
আবছারের মা হাজেরা খাতুন বলেন, আমার ছেলে পেটের জ্বালায় সাগরে মাছ শিকারে গিয়েছিল। কারণ এলাকায় কোন কাজ নেই বলে। ছেলে তো অনেক টাকা ধার-দেনা করে গেছে। প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো। এখন এই পরিবার নিয়ে কি গতি হবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
এদিকে ট্রলার ডুবির ঘটনায় পুরো কদমতলি গ্রামে শোকের মাতম চলছে। শনিবার ও রোববার সাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় একই গ্রামের নিখোঁজ ৭ জেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ১ জেলে। অবশ্য সাগরে নিখোঁজদের সন্ধানে কাজ করছেন স্থানীয় জেলে ও কোস্টগার্ড সদস্যরা।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি শেখ মুনীর উল গীয়াস বলেন, ট্রলার ডুবির ঘটনায় শনিবার দুই জন ও রোববার সকালে ও বিকেলে ৫ জন জেলের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয় জেলে ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা।
এরা হলেন: নাজির হোসেনের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২৮), ছৈয়দ নুরের ছেলে নুরুল ইসলাম (৩৫), মৃত মো. সুলতানের ছেলে হোসেন আহমদ (৪২), আবুল হোসেনের ছেলে আজিজুল হক (৩২) ও নুরুল হকের ছেলে মো. আবছার (২২), মোহাম্মদ তৈয়ব ও
সাইফুল ইসলাম। এনিয়ে দুদিনে ট্রলার ডুবিতে ৭ জনের মরদেহ এবং ১১ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো পর্যন্ত খোরশেদ আলম নামের এক জেলে নিখোঁজ রয়েছে।
এদিকে নিখোঁজ জেলে খোরশেদ আলম ফেরার অপেক্ষায় খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাঁধের উপর বসে রয়েছেন স্বজনরা।
নিখোঁজ খোরশেদ আলমের ভাই মোহাম্মদ রফিক বলেন, ট্রলার ডুবির পর থেকে বাঁধের উপর বসে অপেক্ষা করছি কখন ভাই ফিরে আসবে। কিন্তু ৩ দিন পার হয়ে গেলে ভাইয়ের কোন খোঁজ পাচ্ছি না। ট্রলার ও স্পীড বোট নিয়ে সাগরে খোঁজাখুজির কাজও চলছে। ১১ জন জেলে জীবিত উদ্ধার হয়েছে আর ৭ জন জেলের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু আমার ভাই খোরশেদের কোন খোঁজ পাচ্ছি না।
কোস্টগার্ড কক্সবাজার অফিস জানিয়েছে, সাগরে ট্রলার ডুবির পর থেকে কোস্টগার্ডের উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৭ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। বাকি নিখোঁজ একজন জেলেকে উদ্ধারে কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় শুক্রবার দুপুরে নাজিরারটেক চ্যানেলে ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে যায় এফবি মায়ের দোয়া নামে একটি ফিশিং ট্রলার। এই ট্রলারটি মালিক খুরুশকুল লামাজিপাড়ার মৃত শুক্কুর আলীর ছেলে জাকের সওদাগর।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply