শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩১ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক :
করোনা মহামারির কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর কক্সবাজারে এবার নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে চলছে তিন দিনব্যাপী রাখাইনদের জলকেলি উৎসব বা মাহা সাংগ্রেং পোয়ে। সর্ববৃহৎ এ সামাজিক উৎসবকে ঘিরে রাখাইন পল্লীগুলো বইছে আনন্দ-উচ্ছ¡াসের। আর এতে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীরা নাচে-গানে মেতে উঠেছে। প্রতিবছর রাখাইন বর্ষকে বিদায় এবং বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে আয়োজন হয় এ উৎসবের। রাখাইন সম্প্রদায়ের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজন ও পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে উৎসবস্থল।
উৎসব আয়োজকরা জানিয়েছেন, শনিবার ( ১৬ এপ্রিল ) শেষ হয়েছে রাখাইন বর্ষ ১৩৮৩ সন। আর রোববার থেকে শুরু হয়েছে নতুন ১৩৮৪ রাখাইন বর্ষ। জলকেলি বা সাংগ্রেং পোয়ে ধর্মীয় কোন রীতি নয়, সামাজিক রীতি মতে রাখাইন সম্প্রদায় এই উৎসবের আয়োজন করে থাকে। এই উৎসব চলবে আগামী মঙ্গলবার ( ১৯ এপ্রিল ) পর্যন্ত।
তবে এই উৎসবকে ঘিরে নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় হয়েছে গত ১৩ এপ্রিল বাংলা বর্ষের চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে। ওই দিন থেকে রাখাইনরা বৌদ্ধ বিহারগুলোতে পালন শুরু করেন নানান ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠান পালন শেষে নতুন বছরের প্রথমদিন থেকে ( ১৭ এপ্রিল ) শুরু হয় জলকেলি বা সাংগ্রেং পোয়ে। যা চলে তিন দিনব্যাপী।
কক্সবাজারে প্রতিটি রাখাইন পল্লীতে আয়োজন করা হয়েছে উৎসবের প্যান্ডেল। এবার জেলায় অনন্ত অর্ধ-শতাধিক প্যান্ডেলে এ উৎসব পালিত হচ্ছে।
রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন কেন্দ্রিয় কমিটির সভাপতি মংছেন হ্লা রাখাইন বলেন, উৎসব উপলক্ষে রোববার সকালে প্রতিটি রাখাইন পল্লী থেকে আবাল-বৃদ্ধ বনিতা শোভাযাত্রা সহকারে বৌদ্ধ বিহারে যান। এতে অল্প-বয়সীরা মাটির কলস এবং বয়স্করা কল্পতরু বহন করেন। এরপর সেখানে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পর্ব শেষ করেন। বিকালে তরুণ-তরুণীরা বাদ্যযন্ত্র সহকারে দলবেধে ঘুরে বেড়ান জলকেলি উৎসবের প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে।
“ নানা প্রজাতির ফুল আর রঙ-বেরঙের কাগজে সাজানো হয় প্রতিটি প্যান্ডেল। প্যান্ডেলের মাঝখানে থাকে পানি রাখার ড্রামসহ নানা উপকরণ। এতে পানির রাখার এসব উপকরণের এক পাশে অবস্থান করেন তরুণীরা আর অন্য পাশে থাকেন তরুণের দল। তারা নাচে-গানে মেতে উঠে একে অপরের প্রতি ছুড়তে থাকেন মঙ্গলজল। রাখাইনদের বিশ্বাস, এই মঙ্গলজল ছিটানোর মধ্য দিয়ে মুছে যায় পুরাতন বছরের ব্যাথা,বেদনা, গøানি, অপ্রাপ্তি আর অসঙ্গতি। ্এতে নতুন বছরকে শুচিতার মাধ্যমে বরণ করা হয়ে থাকে সকলের মঙ্গল কামনায়। ”
রাখাইনদের এ কমিউনিটি নেতা বলেন, জলকেলি উৎসব চলবে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত। এতে জলকেলি ছাড়াও উৎসবস্থলে আয়োজিত হবে রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মংথেন হ্লা রাখাইন বলেন, রাখাইন বর্ষ বিদায় ও বরণকে ঘিরে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নানা আনন্দ-উচ্ছ¡াসে মেতে উঠে রাখাইন পল্লীগুলো। এতে প্রধান আকর্ষণ জলকেলি বা সাংগ্রেং পোয়ে। আর রাখাইন তরুণ-তরুণীরা সারাবছর মুখিয়ে থাকে এই উৎসবের জন্য। রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব তাদের জাতিসত্ত¡ার অন্যতম পরিচায়ক।
কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক মং এ খেন রাখাইন বলেন, রাখাইন সম্প্রদায়ের জলকেলি বা সাংগ্রেং পোয়ে উপলক্ষ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কক্সবাজার শহরের আছিমং পেশকার পাড়ায় আয়োজন করা হয়েছে কেন্দ্রিয় উৎসবের প্যান্ডেল। এছাড়াও জেলার সদর সহ রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া উপজেলার রাখাইন পল্লীগুলোর অন্তত অধ-শতাধিক প্যান্ডেলে এই উৎসব পালিত হচ্ছে। এসব প্যান্ডেলে উৎসব আয়োজনে কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে।
তিন দিনব্যাপী আয়োজিত এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ জলকেলি ছাড়াও রাখাইন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনারও আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে রোববার বিকালে কক্সবাজার শহরের আছিমং পেশকার পাড়ায় স্থাপিত প্যান্ডেলে জলকেলি উৎসবের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( শিক্ষা ও আইসিটি ) বিভীষণ কান্তি দাশ।
এসময় বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, বাংলাদেশ সকল ধর্ম-বর্ণের জাতিগোষ্টির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এদেশের আবাহমান সংস্কৃতি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। জলকেলি উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। রাখাইনদের পাশাপাশি স্থানীয়রাও এই স্বতস্ফূর্তভাবে উপভোগ করায় এটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
রাখাইনদের সর্ববৃহৎ এই উৎসব নির্বিঘেœ পালনে প্রশাসন সবধরণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক।
রাখাইন বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সভাপতি মং ছেন হ্লা রাখাইনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কক্সবাজার পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান, সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মং উখেন রাখাইন, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. মাঁয়েনু রাখাইন ও আদিবাসী ফোরাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মংথেন হ্লা রাখাইন।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply