শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৩ পূর্বাহ্ন
বিশ্বের ইতিহাসে মিয়ানমারই একমাত্র রাষ্ট্র যা সাংবিধানিকভাবে সেনাশাসিত। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন এর নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী বার্মার ক্ষমতা দখল করার পর থেকে ’ডিভাইড এন্ড রূল’ পলিসি দিয়ে হাজার বছর ধরে আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনদের মধ্যে ঘৃণা ও সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে রেঙ্গুনভিত্তিক জেনারেলরা কৌশলে আরাকানকে দখলে রেখে শাসন, শোষন অব্যাহত রাখতে চায়। যা করার লক্ষে তারা ৫০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গ মুসলিম বিরোধী কাজ করেছে এবং সফল হয়েছে।
বার্মায় সেনাবাহিনী লাগাতার পঞ্চাশ বছরের অধিক কাল বার্মা শাসন করছে। বার্মার সেনাবাহিনীর দীর্ঘ দিনের সংকল্প, পরিকল্পনা হল আরাকান রাজ্যকে রোহিঙ্গা মুসলমানমুক্ত করে বৌদ্ধ রাজ্য করা। সেই লক্ষ্যে বর্মী জেনারেলরা ’বার্মার’ নাম পরিবর্তন করে ’মিয়ানমার’ করেছে, ঐতিহাসিক ’আরাকান’ রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে ’রাখাইন’ করেছে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারে বসবাসকারী ১৩৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকারী নাগরিকত্ব আইন জারী করে আরাকান রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নাই। আগে ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিয়েও আন্তর্জাতিক চাপে লাখে লাখে তাড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাধ্য হয়েছিল মিয়ানমার সেনা শাসকরা। ১৯৯২ সালে আবার রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের মাধ্যমে তাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের ও বিশ্ববাসীর প্রতিক্রিয়া তারা দেখেছে। এবার সেনা শাসকরা আরো কৌশলী হয়ে বিশ্ববাসীকে ধোকা দেওয়ার জন্য গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের নামে বার্মিজ সাবেক জেনারেলের মেয়ে অং সান সুচিকে চুক্তি মাফিক নির্বাচন দেখিয়ে ক্ষমতার কিছু শেয়ার দিয়ে বিশ্বনেতাদের ম্যানেজ করার দায়িত্ব সুচিকে দিয়ে দেয়। যদিও মূল ক্ষমতা সব সময় সেনা জেনারেলদের হাতেই ছিল ও আছে। অং সান সুচির সরকার ছিল সেনাবাহিনীর পুতুল। জাতিসংঘের চাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভেটো পাওয়ার সম্বলিত পরাশক্তি চীনকে গ্যাস, তেল, গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরীর জন্য জমি দিয়েছে, যাতে চীন ইতিমধ্যেই ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। বিশেষ অর্থনৈতিক জোন ও শিল্প পার্ক তৈরী করার জন্য বিপুল জমি দিয়ে তথা আগাম ঘুষ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে চীনকে সম্পূর্ণ বশ করে রেখেছে বর্মী জেনারেলরা। আগের দুইবার রোহিঙ্গাদের বাড়ীঘর অক্ষুন্ন থাকায় বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহনকারী রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নিজেদের বসতবাড়ীতে সহজে পুনরায় জীবনযাপন শুরু করেছিল। এই বার আর রোহিঙ্গাদের বাড়ীঘর সহায় সম্পত্তি কিছুই অক্ষত রাখেনি সেনাবাহিনী। সব আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে চীনের তৈরী বিশেষ ধরনের বোলড্রোজার দিয়ে রোহিঙ্গাদের বাড়ীঘর, মসজিদ মাদ্রাসা, কবরস্থান, ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিলিন করে দিয়েছে। যাতে করে রোহিঙ্গারা ফিরে গিয়ে বসবাসের জায়গা না পায়, ফিরে যাওয়ার ভরসা না পায়, ফিরে যেতে নিরাপদবোধ না করে, ফিরে যেতে আগ্রহ না থাকে। সেনাবাহিনী তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অং চান সুচির দলকে ক্ষমতার শেয়ার কিছু দিয়ে গণতন্ত্র আংশিকভাবে ফেরত দিয়েছে মর্মে বিশ্ববাসীকে ও মিয়ানমারের সাধারণ মানুষকে ধোকা দিয়েছে । অং চান সুচির বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকতে ২০১৭ সালে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাদের মাতৃভুমি আরাকান থেকে জাতিগতভাবে তাড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত নজিরবিহীন অভিযানে গণহত্যা, গণধর্ষণ, বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয়। আগে তাড়িয়ে দেওয়া চার লাখ সহ বাংলাদেশে এগার লাখ রোহিঙ্গাকে পালিয়ে আসতে বাধ্য করে। অং সান সুচির সরকারকে উক্ত সামরিক অভিযান দেশে বিদেশে প্রকাশ্যে সমর্থন করতে বাধ্য করে। বার্মার সামরিক বাহিনীর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে অং সান সুচি নোবেল পুরস্কার সহ বিদেশে অনেক ধরনের পুরস্কার প্রাপ্ত হন। রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত সেনাবাহিনীর গণহত্যা, গণধর্ষণ সমর্থন করায় অং সান সুচি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে নিন্দিত হন এবং একে একে তাকে দেওয়া পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। নোবেল পুরস্কারও ফিরিয়ে নেওয়ার প্রবল দাবী উঠলেও তা প্রত্যাহার করার বিধান না থাকায় নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহার করা হয় নাই। বিশ্বজনমতের চাপে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার অঙ্গিকারে অং সান সুচির বেসামরিক সরকারের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি স্বাক্ষর করার ব্যবস্থা করা হয়। চার বছরের অধিক সময়ের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী একজন রোহিঙ্গাও ফেরত নেওয়া হয় নাই।
অং সান সুচিকে দিয়ে যে কাজগুলি করানো দরকার তা করিয়ে এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বিদেশে যে পুরস্কার পেয়েছিলেন তা প্রত্যাহার করিয়ে, বিশ্বব্যাপী নিন্দিত করিয়ে আবার রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সামরিক বাহিনী পূর্ণ ক্ষমতা দখল করে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে মিয়ানমারের জেনারেলদের এখন বক্তব্য হল তাদের দেশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কোন আইন নাই।
মিয়ানমারের নির্বাচিত স্ট্যাট-কাউন্সিলর অং সান সুচি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ বেশ কিছু নির্বাচিত নেতাকে সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলেও অনেক নির্বাচিত প্রতিনিধি বাইরে আছেন। তারা সেনাবাহিনীর অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে পাল্টা সরকার বা ছায়া সরকার গঠন করেছে। জান্তা সরকারের বাহিনীর বিরুদ্ধে ছায়া সরকার ’পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস’ প্রতিরোধযোদ্ধা বাহিনী গঠন করেছে। পিডিএফ বা পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের বরাত দিয়ে ফ্রি এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তাদের সাথে যুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডারসহ ৮৮জন জান্তা সেনা নিহত হয়েছে। এবারের সেনা শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৬৭ জন মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন। অং চান সুচি দেখছেন, সেনাবাহিনীর হাতে নিহত রোহিঙ্গাদের রক্ত যেমন লাল, মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের রক্তও লাল।
সেনা বাহিনীর হাতে বন্দী মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও ষ্ট্যাট-কাউন্সিলর অং সান সুচির নেতৃত্বে সব বিরোধী দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত পাল্টা সরকার এত বছর পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে রোহিঙ্গাদের ’রোহিঙ্গা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেনাবাহিনীর দ্বারা তৈরী করা ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার আর্ন্তজাতিক প্রেস মাধ্যমে ঘোষণা ও অঙ্গিকার করেছে এবং সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে গণযুদ্ধে রোহিঙ্গাদের সমর্থন ও সহায়তা কামনা করেছে। যদিও আগে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করাও মিয়ানমারে নিষিদ্ধ ছিল। এই অভুতপূর্ব ও সুবর্ণ সুযোগ রোহিঙ্গাদের গ্রহন করা উচিত। বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহনকারী এগার লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে কমপক্ষে দশ হাজার যুবককে মিয়ানমারের ছায়া সরকারের সাথে যোগাযোগ করে যেভাবে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে বেসরকারীভাবে পালিয়ে এসেছিল ঠিক সেভাবে গোপনে মিয়ানমারে প্রবেশ করে ’পিপলস ডিফেন্স ফোর্সে’ যোগদান করা উচিত। মিয়ানমারের ছায়া সরকারের প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সাথে ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের সাথে দেখা করেছে। সে দেশগুলো মিয়ানমারের ছায়া সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বিবেচনা করছে এবং ফ্রান্স ইতিমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে বলে জানা গেছে। ২৬ থেকে ২৮ অক্টোবর ভার্চ্যুয়ালি অনুষ্ঠেয় ১০ দেশের আঞ্চলিক জোট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সহযোগিতা সংস্থার (আসিয়ান) বৈঠক থেকে মিয়ানমারের সেনাশাসক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাই কে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের হাতে ২৩৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। রোহিঙ্গাদের মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছে, রোহিঙ্গাদের উপর নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে, বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়ে দেশছাড়া করেছে মিয়ানমারের যে সেনাবাহিনী তাদের কয় জন সদস্যকে রোহিঙ্গারা হত্যা করেছে বা হত্যার চেষ্টা করেছে? মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এজেন্ট হিসাবে কাজ করা বেঈমান রোহিঙ্গা ও পাকিস্তান ফেরত রোহিঙ্গাদের প্ররোচনায় ও ইন্ধনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভাতৃঘাতি হত্যাকান্ড চলতে থাকলে রোহিঙ্গা জাতি এক সময় নিঃচিহৃ হয়ে যাবে। মিয়ানমারে সামরিক শাসকদের রিবরুদ্ধে নবগঠিত ও যুদ্ধরত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস এর কাধে কাধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শরীক হওয়া ছাড়া রোহিঙ্গাজাতির মুক্তির কোন পথ নেয়। তাই মিয়ানমারের ছায়া সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ সুবর্ণ সুযোগ গ্রহন না করলে রোহিঙ্গাদের আমও যাবে,ছালাও যাবে। সারা জীবন রিফিউজী হিসেবে পরের দয়ার দানের উপর নির্ভরশীল ভিক্ষুক হিসেবে থাকতে হবে।
লেখক : আইনজীবী, কলাম লেখক।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply