শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪১ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : কক্সবাজার শহরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ‘এক রোহিঙ্গা রোগীর ছোট বোনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ অভিযোগ পাওয়া গেছে; এতে ঘটনায় জড়িত থাকায় তিন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, “ধর্ষণ নয়, ইভটেজিং এর অভিযোগ উঠায় তিন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। ”
এদিকে ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর ইতিমধ্যে প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টির পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ঘটনার তদন্তে নেমেছে।
গত ১ জুলাই রাতে ঘটনাটি ঘটলেও সেটা জানাজানি হয় শনিবার সকালে ভূক্তভোগী তরুণীর বোন রোহিঙ্গা রোগীকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়ার পর।
ঘটনাটি ঘটেছে গত ১ জুলাই রাতের যে কোন সময় কক্সবাজার শহরের হাসপাতাল সড়কস্থ ‘জেনারেল হাসপাতাল কক্সবাজার’ নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ছাদে।
হাসপাতালটির তিন কর্মচারী মিলে এক রোহিঙ্গা রোগীর ছোট বোনকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটায়।
জেনারেল হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক আরিফুল ইসলাম জানান, গত ২৭ জুন আর্ন্তজাতিক সংস্থা মেডিসিনস্ স্যান্স ফ্রন্টিয়ারস্ (এমএসএফ-হল্যান্ড) এর উখিয়ার কুতুপালংস্থ হাসপাতালের রেফার করা এক রোহিঙ্গা নারী রোগীকে জরায়ু সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এমএসএফ এর এক নারী প্রতিনিধি ওই রোহিঙ্গা রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
পরে ওই রোহিঙ্গা রোগীকে (২৩) হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার ৬০৪/এ নম্বর সিটে ভর্তি রাখা হয়। রোগীর সঙ্গে হাসপাতালে আসে ১৭ বছর বয়সী এক ছোট বোন।
তারা উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ১৪ নম্বর হাকিম পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। তবে জেনারেল হাসপাতালে রোগীর ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে উখিয়ার কুতুপালংস্থ এমএসএফ-হল্যান্ড হাসপাতাল।
ঘটনায় অভিযুক্ত হাসপাতালটির চাকুরিচ্যুত কর্মচারীরা হল, হাসপাতালের সিকিউরিটিম্যান নুরুল হক (২৬), লিফটম্যান আতাউর রহমান (২২) ও অফিস সহকারি (পিয়ন) মো. শফি (২০)।
ভূক্তভোগী তরুণীর মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তিন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করলেও এখনো পর্যন্ত আইন-শৃংখলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কোথাও লিখিত অভিযোগ দায়ের করেননি।
ঘটনার ব্যাপারে জানতে এমএসএফ-হল্যান্ড এর কক্সবাজারস্থ অফিসের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ভূক্তভোগী তরুণীর ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর চাওয়া হলে প্রতিবেদককে জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
এরপর হাসপাতালটির ( জেনারেল হাসপাতাল ) সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রোগী ও ভূক্তভোগী তরুণীর নাম জানালেও ঠিকানা জানিয়েছেন উখিয়ার কুতুপালংস্থ এমএসএফ-হল্যান্ড হাসপাতাল।
এ নিয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দৌজা নয়ন বলেন, নানা মাধ্যমে কক্সবাজার শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এক রোহিঙ্গা নারী রোগীর ছোট বোন ধর্ষিত হওয়ার খবর শুনেছেন। ঘটনাটির ব্যাপারে এমএসএফ-হল্যান্ড এর সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখা চাওয়া হবে।
এতে ঘটনার ব্যাপারে সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্ত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে প্রাপ্ত অভিযোগে জানা গেছে, গত ২৭ জুন জরায়ু সমস্যা নিয়ে উখিয়ার কুতুপালংস্থ এমএসএফ-হল্যান্ড হাসপাতাল থেকে এক রোহিঙ্গা নারী রোগীকে কক্সবাজার শহরের হাসপাতাল সড়কের ‘জেনারেল হাসপাতাল কক্সবাজার’ এর ৬০৪/এ নম্বর সিটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সঙ্গে আসেন তার এক ছোট বোন।
গত ১ জুলাই রাতে রোহিঙ্গা নারী রোগী ভর্তি থাকা ওই ওয়ার্ডে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন। এ সুযোগে হাসপাতালটির সিকিউরিটিম্যান নুরুল হক, লিফটম্যান আতাউর রহমান ও অফিস সহকারি (পিয়ন) মিলে রোহিঙ্গা রোগীর ছোট বোনকে কৌশলে ছাদে নিয়ে যায়। পরে তিনজন মিলে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করে।
পরদিন গত ২ জুলাই ভূক্তভোগী তরুণী ও তার রোগী বোন ঘটনার ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন। অভিযোগের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই দিন রাতে দায়িত্বে থাকা সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এক স্থানে জড়ো করে। পরে ভূক্তভোগী তরুণীকেও সেখানে নিয়ে আসা হয়। এসময় সেখানে উপস্থিত থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ঘটনায় জড়িত থাকা তিনজনকে চিহ্নিত করে ভূক্তভোগী তরুণী। এ ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্ত তিন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করেছেন।
এদিকে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া স্বত্ত্বেও রোহিঙ্গা রোগীকে শনিবার সকালে ছাড়পত্র দিয়ে সংশ্লিষ্টরা দ্রুত হাসপাতাল ত্যাগ করান বলে প্রাপ্ত অভিযোগে জানা যায়।
তবে তিন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করার বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করলেও ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন জেনারেল হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক আরিফুল ইসলাম।
আরিফুল বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন যে পরিমান জনবল, রোগী ও তাদের স্বজনরা উপস্থিত থাকেন; এ রকম পরিবেশে ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই। ঘটনার দিন রাতে ধর্ষণ নয়, রোগীর এক স্বজনের সঙ্গে ইভটেজিংয়ের ঘটনা ঘটেছে।
“ ভূক্তভোগী তরুণীর কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত তিন কর্মচারীকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। ”
আইনের দিক থেকে ইভটেজিংয়ের মত ঘটনাটিও অপরাধ এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শুধু নিজেরাই কেন ব্যবস্থা নিয়েছে এ ব্যাপারে একটি ব্যাখা দেন হাসপাতালটির এ মহাব্যবস্থাপক।
আরিফুল বলেন, “ভুক্তভোগী তরুণী অবিবাহিত। তার ভবিষ্যত জীবনের কথা চিন্তা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি ব্যাপক আকারে রূপ দিতে চায়নি। তাই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযুক্ত ৩ কর্মচারীকে তাৎক্ষণিকভাবে চাকুরিচ্যুত করেছেন। ”
মূলত: এ কারণে হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর স্বজনের সঙ্গে সংঘটিত ইভটেজিং ঘটনাটি আইন-শৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়নি বলে মন্তব্য করেন হাসপাতালটির এ মহাব্যবস্থাপক।
আরিফুল জানান, হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী সুস্থ হয়ে উঠায় এমএসএফ-হল্যান্ডের এক প্রতিনিধির মাধ্যমে শনিবার সকালে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে জেনারেল হাসপাতাল ও এমএসএফ-হল্যান্ড কর্তৃপক্ষ নানা যোগসাজশ চালিয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন উঠেছে।
এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা এমএসএফ-হল্যান্ডের উখিয়ার কুতুপালংস্থ হাসপাতালে সহকারি সমন্বয়ক ডা. ফাতেমা জিন্নাত বলেন, জরায়ু সমস্যা নিয়ে জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোহিঙ্গা নারী রোগী মোটামুটি সুস্থ হয়েছেন। শনিবার সকালে ছাড়পত্র নিয়ে তাকে এমএসএফ এর কুতুপালংস্থ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে তিনি আরো কয়েকদিন চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে থাকবেন।
তবে ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটার ব্যাপারে কোন ধরণের অভিযোগ এখন পর্যন্ত রোগী ও তার বোনের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি বলে জানান এমএসএফ-হল্যান্ডের কুতুপালংস্থ হাসপাতালের এ সহকারি সমন্বয়ক।
ঘটনার ব্যাপারে কক্সবাজার স্বাস্থ্য বিভাগের জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, গণমাধ্যম কর্মিদের কাছ থেকে ঘটনাটি শুনেছেন। খবরটিকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান সিভিল সার্জন।
এদিকে হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর এক ছোট বোন ধর্ষিত হওয়ার খবরটি জানাজানি হওয়ার পর থেকে ঘটনার তদন্তে নেমেছে পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
এ ব্যাপারে রোববার বিকালে ঘটনার তদন্তে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারি কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. সেলিম উদ্দিন বলেন, ঘটনার ব্যাপারে ভূক্তভোগী ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত বা মৌখিক কোন ধরণের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের মাধ্যমে পুলিশ খবরটি অবহিত হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়েছে।
“ এছাড়া ঘটনাস্থলে গিয়ে ভূক্তভোগী তরুণী ও তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। তাই অভিযোগের ব্যাপারে সত্যতা কতটুক আপাতত বলা সম্ভব হচ্ছে না। ”
তারপরও ভূক্তভোগী ও তার পরিবারের কেউ অভিযোগ দিলে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান পরিদর্শক সেলিম।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply