রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৯ পূর্বাহ্ন
বাংলা ট্রিবিউন : করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এরই মধ্যে বাংলাদেশে ঢুকে গেছে। এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কি ভয়ংকর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত। তাদের মতে, সংক্রমণের মাত্রা যদি ভারতের অর্ধেক হয়, তাহলেও ভেঙে পড়বে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আমাদের হাসপাতালের যে সক্ষমতা রয়েছে তাতে রোগী সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।
এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভারত থেকে আসা ৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করে বাংলাদেশে দুইজনের শরীরে নিশ্চিত এই ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। আরও চারজনের শরীরে এই ভ্যারিয়েন্টের খুব কাছাকাছি একটি ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা ভারতের এই ভ্যারিয়েন্টের ছড়িয়ে পড়াকে অনেকটা অবধারিত বলেই মনে করেন। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ধীরে ধীরে এটা ছড়াবেই। একে বন্ধ করে রাখা যাবে না।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্তে অনেকগুলো স্থলবন্দর । এই বন্দর দিয়ে পণ্যবাহী ট্রাক আসছে। আসছেন ট্রকের চালক এবং অন্য সহযোগীরা। তাদের কোয়ারেন্টিন হচ্ছে না। অথচ তারা এখানেই থাকছেন, এদেশের মানুষের সঙ্গে ব্যবসায়ী লেনদেন করছেন, ঘুরছেন। তাদের মাধ্যমে এ ভ্যারিয়েন্ট দেশে ঢোকার আশঙ্কা সবসময়ই ছিল।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকদিন আগে ঘোষণা করা হলেও আমাদের আশঙ্কা ভারতীয় এই ভ্যারিয়েন্ট কয়েকমাস আগেই চলে এসেছে। বাংলাদেশের তিনদিকেই ভারত। সবসময় স্থলবন্দর দিয়ে মানুষ যাতায়াত করছে। কিছুই থেমে ছিল না। ফলে ভারতীয় এই ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে না ঢোকার কোন কারণ নেই।
অধ্যাপক নজরুল ইসলামেরও একই আশঙ্কা। তার মতে, সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট প্রথমে ঢাকায় ঢুকেছিল। কিন্তু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এভাবে আসবে না। এটি আসবে স্থলবন্দর দিয়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়াতে ছড়াতে ঢাকায় ঢুকবে। এর স্প্রেডিং ধরণ ভিন্ন রকম হবে। প্রথমে ঢাকার বাইরে ছড়াবে বলে এনিয়ে আশঙ্কাও থাকবে বেশি। কারণ সেসব জায়গায় চিকিৎসার ব্যবস্থা ভালো না। ফলে অনেক বেশি মানুষ মারা যাবে।
পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে এরই মধ্যে গত ১৫ দিনে ভারতে যাতায়াতকারীদের তালিকা চেয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক। তিনি সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক হারে করোনার নমুনা পরীক্ষা চালাতে ও ভারত যাতায়াতকারীদের পরিবারের সকলকে বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে নির্দেশনা দিয়েছেন। তাছাড়া বর্ডার এলাকা থেকে কোনো যানবাহন যাতে অন্য জেলায় যাতায়াত না করতে পারে সেটি নিশ্চিত করার জরুরি নির্দেশনাও দিয়েছেন। জাহিদ মালিক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষ যেভাবে চলাচল করছে তাতে ঈদের পর ভারত, নেপালের মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশেও হতে পারে।
সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও। আবু জামিল ফয়সাল জানান, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির সভায় গতসপ্তাহে তারা সীমান্ত এলাকাতে নমুনা পরীক্ষা, আইসোলেশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং এবং কোয়ারেন্টিন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ( আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেনের মতে ভারতে নির্বাচনী জনসভা, কুম্ভমেলা, কৃষক বিক্ষোভের কারণে সংক্রমণ অনেক বেড়েছে আর নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়েছে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তাহলে ভারতের ভ্যারিয়েন্টের দ্বারা আমরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবো। সেই সঙ্গে এ থেকে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হবার আশঙ্কাও থাকবে।
চলতি বছরের মার্চ এপ্রিলে যখন দেশে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছিল, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ডা. মুশতাক বলেন, মার্চ এপ্রিলে ছোট্ট একটা ধাক্কা দিয়েছিল। সেই ধাক্কা সামলাতেই আমাদের অবস্থা নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল। এখন নতুন করে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রবল ঢেউ এলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে আগে সংক্রমণ থাকলেও খুব একটা গুরুতর ছিল না, সেই কৃষকরা কিন্তু এবার মারা গেছে। এসব কৃষকরা মাইগ্রেটরি কৃষক, যারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। ঠিক একই বিষয় ঘটছে আমাদের এখানে এই ঈদের সময়ে, লোকজন দলবেধে এক জেলা থেকে আর এক জেলায় যাতায়াত করছে। এতে করে ভাইরাসটা ছড়াতে ছড়াতে তাদের মধ্যেও গুরুতর হবার সক্ষমতা অর্জন করেছে। আমাদের দেশেও ভাইরাস যদি অধিক সংখ্যায় ছড়াতে থাকে তাহলে শ্রমজীবী এবং তরুণ- আপাতভাবে যারা নিরাপদ বলে আমরা ভাবছি, তারাও গুরুতরভাবে আক্রান্ত হতে পারে।
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা সম্পর্কে ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, আশঙ্কা করতেই পারি এ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা আগের ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে বেশি। আর নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হলেই তার সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি হয়। ভারত, নেপাল, পাকিস্তানের সংক্রমণ দেখেই আমাদের সতর্ক হতে হবে।
ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আমাদের দেশে সংক্রমিত হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, দেশের সব উপজেলাতে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা নেই। ভারতের যে সংক্রমণ তার অর্ধেকও যদি বাংলাদেশে হয় তাহলে হাসপাতাল ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। তাই একমাত্র উপায়- সংক্রমণ কমাতে হবে। সংক্রমণ যদি না কমানো যায় পরিস্থিতি সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রোগী শনাক্ত করে তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা ও আইসোলেশনে রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হবে।
অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামও বলেন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কথা। তবে পাশাপাশি তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় কিছু হতাশার কথাও । তিনি বলেন, আমাদের দেশে ভাইরাস যেন না ছড়ায় তার জন্য অনেক বিধি নির্দেশনা দেওয়া হয়, কিন্তু সেগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালন হয় না। দেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু তারপরও সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থাও নেই অনেক জায়গায়। আর গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি করার সক্ষমতাতো নাই-ই, ইচ্ছাও বোধহয় নাই।
ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ভারত এবং পাকিস্তানের মানুষের সামাজিক অবস্থা, স্বভাব, জনসংখ্যার ঘনত্ব সবই বাংলাদেশের মতো। অতএব, তাদের যে পরিণতি হয়েছে আমাদের তা হবে না- এরকম মনে করার কোনও কারণ নেই। তাই সেভাবেই বাংলাদেশের প্রস্তুত থাকতে হবে, সে প্রস্তুতি নিতে হবে, বলেন তিনি। সে প্রস্তুতি আমরা কতটুকু নিতে পেরেছি, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
রোগীদের শনাক্ত করে তাদের আইসোলেশনের কোনও বিকল্প নেই বলে জানান জনস্বাস্থ্যবিদ ও পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, যতক্ষণ না টেস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে রোগীদের শনাক্ত করে যথাযথ আইসোলেশন করা না যাবে, তাদের সংর্স্পশে আসাদের কোয়ারেন্টিন না করা যাবে, ততক্ষণ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রন হবে না।
একই কথা জানান ডা.মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন রোগীদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানেই সংক্রমণের খবর পাওয়া যাবে, তাদেরকে আলাদা করে ফেলতে হবে। বাড়িতে আইসোলেশনে থাকাদের বিষয়ে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply