শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৮ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে এখন নির্বাচনী আলোচনায় উত্তাল। আর উত্তালের কারণ আলোচিত এবং আত্মঘোষিত কারাগার ফেরত ইয়াবা কারবারিদের গণসংযোগ নিয়ে। টেকনাফের একটি পৌরসভা ও ৬ টি ইউনিয়নে অনন্ত ৭৭ জন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি নির্বাচনের ঘোষণা মাঠে তৎপরতা চালাচ্ছেন।
সাধারণ জনগণ জানিয়েছেন, তারা কোন ভাবেই চান না ইয়াবা কারবারিরা প্রার্থী হোক, হলেও তারা যেন নির্বাচিত হতে না পারেন। তারা মনে করছেন, ইয়াবা কারবারিরা নির্বাচিত হলেও অনেক সময় পালাতক থাকে। আবার কারাগারে থাকে এতে জনগণ সঠিক সেবা পান না। সচেতন মহল মনে করেন, ইয়াবা কারবারি প্রার্থী বা নির্বাচিত হলে মাদক রোধ অসম্ভব হবে। মাদক কারবারিদের প্রার্থীতা বাতিলের আইন প্রণয়নের দাবি তাদের। পুলিশ বলছে, কারাগার ফেরত মাদক কারবারিদের নজরধারীতে রাখা হয়েছে। এদের সামাজিকভাবে বয়কট করার আহবান তাঁর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা, সাবরাং, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ সদর ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হয়েছে। যে ৫ টি ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ ১১ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ১৮ মার্চ। মনোনয়নপত্র বাছাই ১৯ মার্চ এবং প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৪ মার্চ। এর বাইরে টেকনাফ পৌরসভা ও বাহারছড়া ইউনিয়নের তফসিল এখনো ঘোষণা হয়নি।
তবে তফসিল ঘোষণা না হলে টেকনাফ পৌরসভায় এখন সবচেয়ে বেশি সংখ্যক চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি’র ভাই আবদুস শুক্কুর। তিনি মেয়র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীও। এই আবদুস শুক্কুর ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এর হাত থেকে ফোন নিয়ে আত্মসমর্পন করেছিলেন। ওই মোট ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পন করেন। ২০২০ সালের নভেম্বরের শুরুতে আবদুস শুক্কুরের জামিনে মুক্তি পান। এর পর থেকে টেকনাফ পৌরসভায় আওয়ামীলীগ মেয়র প্রার্থীর মনোনয় প্রত্যাশী ঘোষণা দিয়ে গণসংযোগ করতে দেখা গেছে। টেকনাফ পৌরসভার মেয়র প্রার্থী সহ ৯ টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে অনন্ত ২০ জন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি প্রচারণা চালাচ্ছেন। যারা চিহ্নিত এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত ইয়াবা কারবারি। যাদের বেশিভাগের বিরুদ্ধে রয়েছে ইয়াবা ও অস্ত্র মামলা।
তফসিল ঘোষিত টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচারণাকারি ৪ জন চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি। যার মধ্যে বর্তমান চেয়ারম্যান শাহাজান মিয়াও রয়েছে। যার বিরুদ্ধে ইয়াবা ও অস্ত্র আইনে কয়েকটি মামলা রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টার সময় শাহাজান মিয়াকে আটক করা হয়। পুলিশ তাকে টেকনাফ ফিরে এনে ২৮ জুলাই লেঙ্গুর বিল বাড়িতে অভিযান চালায়। এতে ৫০ হাজার ইয়াবা, ৪টি দেশীয় অস্ত্র (এলজি) ও ২৫টি তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়। এ মামলায় কারাগারে পাঠানো হলেও জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকায় ফিরেন গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে। তখন থেকে নিজে প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এই শাহাজান মিয়া সহ তার পিতা ও ভাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত ইয়াবা কারবারি। ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পনের সময় তাঁর এক ভাইও ছিলেন।
যদিও শাহাজান মিয়া তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা সকল মামলা মিথ্যা ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর প্রতিপক্ষ মহল ষড়যন্ত্র করে তাঁর বিরুদ্ধে এসব মামলা করেছে। তিনি বলেছেন, তিনি ইয়াবা সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, তাঁর জনপ্রিয়তাকে ঘায়েল করতে এমন প্রচারণা চালানো হয়।
২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পনকারি মধ্যে ছিলেন টেকনাফের গোদার বিল এলাকার আলী আহমদের পুত্র জিয়াউর রহমান। তিনিও সম্প্রতিজামিনে মুক্ত পেয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি বিএনপি মনোনয়ন প্রত্যাশি। টেকনাফের ছোট্ট হাবির পাড়ার খলিলুর রহমানের পুত্র হাম জালালও এক ইয়াবা মামলায় কারামুক্ত ব্যক্তি। যিনি আওয়ামীলীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছে। হাম জালালও তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা মিথ্যা বলে দাবি করেছেন।
একই ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ ইয়াবা কারবারির আত্মসমর্পনকারি টেকনাফে এনামুল হকও আবার ইউপি সদস্য প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। টেকনাফ সদর ইউনিয়নে এ রকম আরো ১৩ জন চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থী পাওয়া গেছে যারা চিহ্নিত এবং তালিকাভূক্ত ইয়াবা কারবারি।
টেকনাফ সদর ইউনিয়ন ছাড়াও অন্যান্য ইউনিয়নে ইয়াবা কারবারিরা প্রার্থী হিসেবে প্রচারণার তথ্য পাওয়া গেছে। যেখানে সাবরাং ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী সহ ১৪ জন, বাহারছড়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী সহ ৫ জন, হ্নীলা ইউনিয়নে চেয়ারম্যানে প্রার্থী সহ ১১ জন, হোয়াইক্যং ইউনিয়নে ৭ জন ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে ৩ জন প্রার্থী রয়েছে যারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত ইয়াবা কারবারি।
সাধারণ জনগণ তাদের বয়কট করার ঘোষনা দিয়েছেন। টেকনাফের আবদুল খালেক নামের এক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, ইয়াবা কারবারিরা নির্বাচিত হলেও কোন সেবা পান না। বছরের বেশিভাগ সময় আত্মগোপনে পালিয়ে বেড়ান। আবার অনেকেই কারাগারে থাকেন। এদের ভোট দেয়া না দেয়া একই।
আবুল বশর নামের এক তরুণ বলেন, টেকনাফের ইয়াবার বদনাম দূর করতে হবে। এবার নির্বাচনে ইয়াবা কারবারিদের বয়কট করা হবে।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আয়াছুর রহমান জানান, আত্মসমর্পনকারি ইয়াবা কারবারি অর্থ তারা স্বঘোষিত মাদক কারবারি। যারা আদালতের মাধ্যমে জমিন পেলে এলাকায় ফিরেছে। সম্প্রতি নির্বাচনে তারা প্রার্থী হিসেবে মাঠে গনসংযোগ শুরু করেছে। এরা যদি জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসে তাহলে এলাকার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে যাবে এটা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এসব বিষয় সরকারের দৃষ্টিতে এনে এরা প্রার্থী হতে না দেয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী বলে মনে করেন তিনি।
কক্সবাজারের বিশিষ্টজন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাহামুদুল হক চৌধুরী জানান, এখন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা ইয়াবা। ইয়াবা কারবারিরা তাদের ব্যবসার নিরাপত্তার জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। সরকারের উচিত তাদের প্রার্থী হওয়ার সুযোগ না দেয়া। তাই দ্রুত আইন প্রণয়নের দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান জানান, কারা ফেরত বা তালিকাভূক্ত ইয়াবা কারবারিদের উপর কঠোর নজরধারী রাখা হয়েছে। পালাতক মাদক মামলার আসামী গ্রেফতারে ধারাবাহিক অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। এখন সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন তৈরী করতে হবে।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply