বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২০ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক: টানা তিনদিনের ছুটিতে কক্সবাজারে বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগমকে পুঁজি করে হয়রানি ও ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে; এতে আবাসিক হোটেল-মোটেল ও খাবার রেস্তোরাসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আদায় করা হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্য। যেন চলছে অন্যরকম নৈরাজ্য।
এদিকে পর্যটনের চলতি মৌসুমের এসময়ে বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটায় হোটেল-মোটেল জোনসহ কক্সবাজার শহরের সবক’টি আবাসিক হোটেল কক্ষ বুকিং হয়েছে। এতে হোটেলে ঠাঁই না হওয়ায় আগত মানুষদের অনেককে রাত্রিযাপন করতে হয়েছে যাত্রিবাহি বাস, সৈকতের কিটকটে (বিনোদন ছাতা); আবার অনেককে সৈকতের খোলা আকাশের নিচে। কেউ কেউ অবস্থান নিয়েছেন স্থানীয়দের কারো কারো বাসা-বাড়ীতেও। এদের মধ্যে সবচাইতে বেশী দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পরিবারসহ ভ্রমণ করতে আসা লোকজনদের।
থাকার ব্যবস্থা না হওয়ায় পর্যটকদের অনেকে অবস্থান নিতে হয়েছে কক্সবাজার শহরের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ও উপজেলা সদরেও।
স্থানীয়দের বাসা-বাড়ীতে থাকতে গিয়ে আগত পর্যটকদের কাউকে কাউকে পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়ও। এদের কেউ কেউ খুইয়েছেন নগদ টাকা, মোবাইল ফোন সেট ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও।
এতে আগত অনেক পর্যটক ভ্রমণসূচী সংক্ষিপ্ত করে ফিরে যাচ্ছেন কক্সবাজার থেকে।
ট্যুরিস্ট পুলিশসহ পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা ৩ দিনের ছুটিকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে এখন অবস্থান করছে অন্তত ৪ লক্ষাধিক পর্যটক। এতে একই সময়ে বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটায় নানা হয়রানি ও ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে। এক শ্রেণীর দালাল চক্র যোগসাজশ করে আগে থেকে নিজেদের নামে হোটেল কক্ষ বুকিং করে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করে এ ধরণের নৈরাজ্য হচ্ছে।
তবে টানা ছুটিতে এক সাথে অসংখ্য পর্যটক সমাগম ঘটায় সীমিত জনবল দিয়ে পর্যাপ্ত সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান ট্যুরিস্ট পুলিশের সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোন এলাকার আবাসিক হোটেল রিগ্যাল প্যালেসে অবস্থানকারি আবুল কাশেম বলেন, ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকুরি করেন। করোনা মহামারির কারণে গত এক বছর এক প্রকার বন্দি জীবনযাপন করেছেন। টানা ৩ দিন সরকারি ছুটি থাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে এসেছেন। কিন্তু হোটেল কক্ষ বুকিং করতে গিয়ে গুনতে হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুন বেশী ভাড়া।
“ আমি এর আগেও কক্সবাজার বেড়াতে এসে ওই হোটেলে ( রিগ্যাল প্যালেস ) অবস্থান করেছিলাম। তখন ডাবল-বেডের একটি কক্ষের ভাড়া নিয়েছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু এবার ওই হোটেলে অবস্থান করতে গিয়ে একটি কক্ষের ভাড়া আদায় করতে হয়েছে ৬ হাজার টাকা। ”
টানা ছুটিতে বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটায় প্রতিটি আবাসিক হোটেলেই সবগুলো কক্ষ বুকিং হওয়ায় থাকার জন্য বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন এ পর্যটক।
ঢাকার সাভার থেকে আসা আব্দুল হালিম নামের এক পর্যটক বলেন, চাকুরির কারণে সারাবছরই ব্যস্ততার মধ্যে থাকতে হয়। এবার টানা ৩ দিন সরকারি ছুটি থাকায় ৫ বন্ধু মিলে কক্সবাজার ঘুরতে এসেছেন।
“ কিন্তু কক্সবাজার পৌঁছার পর দেখতে পেলাম এই ছুটিতে বিপুল সংখ্যক পর্যটক ঘুরতে এসেছেন। অনেক হোটেলে যোগাযোগ করার পরও থাকার জন্য একটি কক্ষও বরাদ্ধ পাইনি। ”
এ পর্যটক বলেন, “ থাকার জন্য কোথাও ব্যবস্থা না হওয়ায় ৫ বন্ধু মিলে শুক্রবার সৈকতের কিটকট ভাড়া নিয়ে রাত্রিযাপন করেছেন। ”
এদিকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে এসে হোটেল কক্ষ বরাদ্ধ না পাওয়ায় স্থানীয় এক বাসিন্দার বাসায় রাতে অবস্থান করেছেন বলে জানান সুফিয়া খাতুন নামের এক পর্যটক।
সুফিয়া বলেন, অনেক খুঁজাখুঁজির পরপরও কোন হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে স্থানীয় এক বাসিন্দার বাসার একটি কক্ষ ভাড়া দিয়ে তারা রাত কাটিয়েছেন। এ জন্য তাদের ভাড়া দিতে হয়েছে ৫ হাজার টাকা।
“ শুধু আমরা নই, আমাদের আরো কয়েকটি পরিবারকে ওই স্থানীয় বাসিন্দার বাসায় ভাড়া দিয়ে রাত্রিযাপন করেছেন। ”
তবে এতেও তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে জানিয়ে এ নারী বলেন, “ রাত কাটানোর পর শনিবার সকালে স্থানীয় বাসিন্দার বাসার কক্ষে নগদ টাকাসহ সব জিনিসপত্র রেখে পরিবারের সবাই ঘুরতে বের হন। কিন্তু ফিরে এসেছে তারা দেখেন, সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা অবস্থায়। ”
“ এতে স্থানীয় বাসিন্দার বাসায় ভাড়া নেয়া ওই কক্ষে রেখে যাওয়া নগদ ২০ হাজার টাকা, একটি মোবাইল ফোন সেট ও কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। এ নিয়ে পুলিশের কথা জানালে ৮ হাজার টাকা ফেরত দিলেও অপর ১২ হাজার টাকা এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পাইনি। ”
তারপরও ঘুরতে এসে আর কোন বিড়ম্বনা না বাড়িয়ে ওই বাসা থেকে চলে আসেন বলে জানান সুফিয়া খাতুন।
রাজশাহী থেকে ঘুরতে আসা কামরুল হাসান বলেন, সেখানকার (রাজশাহী) স্থানীয় একটি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে তারা ৪০ জনের একটি দল বাস যোগে শুক্রবার কক্সবাজার ঘুরতে আসেন। কিন্তু কোন হোটেল কক্ষ ভাড়া না পাওয়ায় তারা সবাই বাসে রাত্রিযাপন করেছেন।
“ কিন্তু কক্সবাজার এসে দেখতে পেলাম খাবার থেকে শুরু প্রত্যেকটি জিনিসের অতিরিক্ত দাম গুনতে হয়েছে। এক টুকুরো পোঁয়া মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে দাম দিতে হয়েছে ১৮০ টাকা। এক লিটার মিনারেল ওয়াটার কিনতে হয়েছে ৩০ টাকায়। গোসল করতে প্রতিজনকে গুনতে হয়েছে ৫০ টাকা। টয়লেট ব্যবহার করতে প্রতিজনকে ২০/৩০ টাকা করে দিতে হয়েছে। গাড়ি পাকিংয়ের জন্য দিতে হয়েছে ৮০০ টাকা। ”
তবে এক শ্রেণীর দালাল চক্রের যোগসাজশের কারণে পর্যটকদের হোটেল কক্ষের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করেছেন কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশে সিকদার।
আবুল কাশেম বলেন, টানা ছুটির দিন থাকলে কক্সবাজারে বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগম ঘটে। এতে বুকিং হয়ে যায় সাড়ে ৪ শতাধিক হোটেল-মোটেলের সবক’টি কক্ষ। আর বিপুল সংখ্যক পর্যটক সমাগমকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে উঠে এক শ্রেণীর দালাল চক্রও।
“ টানা ছুটির দিনগুলোর আগেভাগে দালাল চক্রের লোকজন নিজেদের নামে প্রত্যেকে ৮/১০ টি করে হোটেল কক্ষ বুকিং করে রাখে। এতে এক ধরণের কৃত্রিম সংকটের তৈরী হয়। পরে আগত পর্যটকরা হোটেল কক্ষ বরাদ্ধ না পেয়ে দালাল চক্রের লোকজনের কাছে দ্বারস্ত হতে বাধ্য হন। এতে পর্যটকদের কাছ থেকে আদায় করা হয় স্বাভাবিকের চাইতে কয়েক গুন বেশী ভাড়া। ”
তবে এ ধরণের প্রবণতা মালিকদের নিজস্ব পরিচালনাধীন হোটেলগুলোতে নয়; মূলত ভাড়া-উপভাড়ায় পরিচালিত হোটেলে বেশী ঘটে থাকে বলে মন্তব্য করেন এ হোটেল-মোটেল মালিক নেতা।
এ ব্যাপারে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর জন্য দাবি জানান আবুল কাশেম সিকদার।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের পরিদর্শক মো. শাকের আহমদ বলেন, টানা ৩ দিনের ছুটিতে এখন কক্সবাজারে ৪ লাখের বেশী পর্যটক সমাগম ঘটেছে। পর্যটকদের নিরাপত্তায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে পুলিশের ১৭ টি দল দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া ভ্রাম্যমান নিরাপত্তা দলের পাশাপাশি সাদা পোষাকেও পুলিশ কাজ করছে। পাশাপাশি একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে ভ্রাম্যমান আদালতও।
পর্যটক হয়রানি ও ভোগান্তি নিয়ে কিছু খবর পুলিশ পেলেও বিপুল সংখ্যক আগত লোকজনকে সীমিত জনবল নিয়ে সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জাানান ট্যুরিস্ট পুলিশের এ কর্মকর্তা।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply