মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৭ পূর্বাহ্ন
প্রথমে সবাই মিলে বিজন শীল আর গণস্বাস্থ্যকে ধোলাই করা হলো। তারপর তোপের মুখে পড়লেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাদানুবাদের শেষ নাই। তারা আসলে কী অপরাধ করেছিলেন? সারা দুনিয়া যখন করোনাভাইরাসে যা তা অবস্থায় ধুঁকছে তখন এরা চেষ্টা করেছিলেন যদি কোনো সুরাহা করা যায়। এমন না যে তারা সরকার বা প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। না তারা করেছিলেন কোনো ডাকাতি, দুর্নীতি কিংবা ব্যাংক লুট। তারা তাদের সাধ্যমতো একটা কিট আবিষ্কারের চেষ্টা করেছিলেন। এরপর আমরা দেখেছি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজে কোভিড আক্রান্ত হয়ে তারপর সুস্থ হলেন। তাদের কথামতো এই কিট সফল বা সঠিক। কিন্তু জাতি কোনো সুযোগ পেলো না এর যথার্থতা যাচাইয়ের। হঠাৎ পাগল হয়ে ওঠা প্রশাসন তড়িঘড়ি সংবাদ সম্মেলন করে বিষয়টি ফয়সালা করার জন্য নেমে পড়েছিল মাঠে। তাদের কথার ভেতরও ফাঁক ছিল বৈকি। কিন্তু মূল কথা হলো মানুষ সত্য মিথ্যা কিছুই বুঝল না। জাতি যথারীতি দুই ভাগে ভাগ হয়ে নেমে গিয়েছিল বাকযুদ্ধে। মাঝখানে সরকার ও প্রশাসনই হারালো তাদের গ্রহণযোগ্যতা। ঐ যে কথাটা বারবার বলা হচ্ছে সমন্বয়হীনতা আসলেই তা সত্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক বিষয় জানেনই না। আর তাকে অন্ধকারে রেখে চলছে নিজেদের বড় করার নামে ছোট করার প্রতিযোগিতা।
এবার আবার মাঠ গরম। ড. আসিফ ভদ্রলোকের পুরো নাম আসিফ মাহমুদ। না তিনি কোনো ডাকাতি, চুরি, রাহাজানি বা ধর্ষণ কিছুই করেননি। তার শিক্ষা জীবনটা চমৎকার। বোর্ডে স্ট্যান্ড, নটেরডেমের মতো কলেজে পড়াশোনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে মাইক্রোবায়োলজিতে ডিগ্রি, মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। এটা তার একমাত্র অপরাধ না, বড় অপরাধ দাবি করছেন তিনি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন।
ব্যাস। শুরু হয়ে গেছে অক্ষমের বিলাপ। সোশ্যাল মিডিয়ার সবজান্তা আর মহাপণ্ডিত দোজখের কীটেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রবল অপ উৎসাহে। তাদের নারকীয় অট্টহাসি দেখে বোঝা যায় আমরা কেমন সংকীর্ণ ও উজবুক এক জাতি হয়ে গেছি। অথচ এই আমরাই বিদেশের এমন কোনো খবরে পাগল হয়ে উঠি। সোশ্যাল মিডিয়া সয়লাব হয়ে যায় প্রশংসা আর স্তুতির জোয়ারে। ধন্য ধন্য করা আমরাই নিজেদের বেলায় ঠিক তার উল্টো।
শেষ গল্পটি, জার্মানী তখন দুই ভাগে বিভক্ত। মাঝখানে বার্লিন দেয়াল। সবাই জানেন পূর্ব জার্মানী ছিল পশ্চিমের তুলনায় পিছিয়ে। তাই পুবের মানুষজন রাগ করে দেয়ালের ওপারে ফেলত ময়লা আবর্জনা। এসব দেখে সবাই পশ্চিম জার্মানীকে বললো তোমরাও কিছু করো। শেষ পর্যন্ত তারা রাজী হলো। কী আশ্চর্য! তারা ফেলতে শুরু করলো কমলা কলা আপেলসহ নানা ধরনের খাবার। জানতে চাওয়া হলো, এর মানে কী? উত্তরে তারা জানাল, যার যা আছে তাই তো দেবে অন্যকে।
গল্পটা মিলে যাচ্ছে। বাঙালি কি উগরে দিচ্ছে বারবার? যেকোনো নতুন কাজ বা আবিষ্কার এমনকি কথাও হজম করতে চাইছি না আমরা। সোশ্যাল মিডিয়া তথা খোলা মিডিয়া মানুষকে দিয়েছে অপার শক্তি। সংবাদপত্র বা চলমান মিডিয়াকে টেক্কা দিয়ে উঠে এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। মানুষ নিজেই একেকটি মিডিয়া। হাতে মোবাইল থাকলেই হলো। এই ওপেন বা উন্মুক্ত মিডিয়ায় এডিটিং বলে কিছু নাই। চাইলে আপনি কাউকে এই এখন মহাপুরুষ বলে প্রশংসা করে পরমুহূর্তে দানব বললেও কেউ নাই কিছু বলার। সব আপনার হাতে। আর এই কারণেই এর ব্যবহারে সর্তকতা জরুরি। শুধু জরুরি না দরকারিও। এর শক্তি কিন্তু ইতোমধ্যে দেখেছি আমরা। মানুষের বাড়িঘর থেকে জান নিতে পারা এই ওপেন মিডিয়া ভালো করলে চূড়ান্ত ভালো কিছুও করতে পারে। ফলে আমাদের সমাজে এর ব্যবহারে অনেক বেশি সাবধানতা দরকার। যারা মনে করেন বিদেশে বা উন্নত দেশগুলোতে এই মিডিয়া অবাধ তারা ভুল জানেন। মূলত এসব দেশে সোশ্যাল মিডিয়া অনেক বেশি সতর্ক আর পরিমিত। আমাদের দেশের মতো সবাই যা জানে বা না জানে তা নিয়ে কথা বলে না। যখন বলে তখন জেনেই বলে। এই যে আসিফকে নিয়ে ট্রল এর সাথে শীঘ্রই যোগ হবে আরো তৎপরতা। সরকার বা প্রশাসন এখনো এ নিয়ে কথা বলেনি। যখন বলবে তখন শুরু হবে আবার বাকযুদ্ধ।
এখন কথা একটাই, আমরা কি আমাদের উপনিবেশ থেকে পাওয়া দাস মনোভাব বদলাতে পারব না। সাতচল্লিশে একবার, একাত্তরে আরেকবার দুই দফায় স্বাধীন দেশ এখনো ভালো কিছু কেন নিতে শেখেনি? এই দায় আসলে কি রাজনীতির না সমাজের? শুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে আমরা বলব সমাজ আর রাজনীতি দুটোই সমান দায়ী। অনেক আগেই পচে গেছে মগজ। এককেন্দ্রিক হতে হতে এখন আর তার বাইরে কিছু ভাবার সাধ্য বা শক্তিও নাই আমাদের। কি যে হীনমন্যতা। কাউকে মানি না আমরা। ইতিহাস আলো করা তিন বাঙালি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বঙ্গবন্ধুকেও না। আসিফ, বিজন শীল তো সে জায়গায় তুচ্ছ। মেরুদণ্ড কি আর এমনি ভাঙে? জগদীশ বসু, সত্যেন বসুর পর বিজ্ঞানীর নাম জানেন? আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন নামে একজন মানুষ ছিলেন দেশে কেউ জানে এখন? জানে কি ড. ইউনুসের ছোট ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহিম কোথায়? যিনি বিজ্ঞানের জন্য কাজ করতেন। মূহাম্মদ জাফর ইকবাল সায়েন্স নিয়ে থাকলে জনপ্রিয় হতেন না। তাই তিনি সাহিত্য রাজনীতি নিয়ে ভালো আছেন। এমন সমাজে কোনো আবিষ্কার বা নতুন কিছু যে তোপের মুখে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। এখন যে উদাহরণটি দেব তার জন্যও মন্দ কথা শুনতে হবে জানি। হয়তো জানেন ইহুদিরা তাদের মেধা দিয়েই দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন একসময় করতে চাইত তামিল হিন্দুরা। তারা পারেনি। কিন্তু ইহুদীরা পারছে। তাদের মূল কথা হলো তুমি কার্ল মাক্স হও আর আইনস্টাইন হও বা জুকারবার্গ তোমার মূল পরিচয় ইহুদি তারপর তুমি হয় জর্মান নয় আমেরিকান। এই অর্জন তারা জাতিকে উৎসর্গ করে বলেই এগিয়ে আছে।
কেন নিজেদের দৈন্য আর হীনতা দেখার এই প্রতিযোগিতা? আসিফ ব্যর্থ হলেও তার এই চেষ্টা লেখা থাকবে সময়ের খাতায়। আর সার্থক হলে তা হবে ইতিহাস। আমরা কি সহনশীল প্রশংসা করতে পারা জাতি হতে পারব না কোনো কালে?
( লেখাটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে সংগৃহিত )
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply