মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৭ অপরাহ্ন
মু. মাহবুবুর রহমান, বিডিনিউজ: বিশ্বের ব্যতিক্রমী জাদুঘরের অন্যতম হলো পানির নিচের কিংবা সাগরতলের জাদুঘর। গত ১৭ জুন শ্রীলংকার গল সমুদ্র সৈকতে উদ্বোধন করা হলো এমনই এক সাগরতলের জাদুঘর।
এটাই দেশটির কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পানির নিচের জাদুঘর। করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে এটি শ্রীলংকার পর্যটন শিল্পকে আরো এগিয়ে নিবে এমন লক্ষ্য নিয়েই চালু করা হলো সাগরতলের এ জাদুঘর।
ভারত মহাসাগর পাড়ে অবস্থিত শ্রীলংকার গল শহর। এটি শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান শহর। রাজধানী কলম্বো থেকে ১১৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বাংশে গল শহরের অবস্থান। ষোড়শ শতকে পর্তুগিজরা এবং পরবর্তীতে ডাচরা এ শহরের উন্নয়নে কাজ করেছে। এর আগে চতুর্দশ শতকে ইতিহাস-বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এ শহরকে ‘কালি’ নামে উল্লেখ করেছিলেন।
এ শহরেই অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত গল ফোর্ট, বাংলায় বললে ‘গল দুর্গ’। চারশো বছরের বেশি সময় আগে ১৫৮৮ সালে পর্তুগিজদের গড়া এ দুর্গ স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন। ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণাকরে। গল দুর্গের মোট আয়তন ৩৬ একর।
তবে গল শহরকে ক্রিকেটপ্রেমীরা চেনে গল স্টেডিয়ামের কারণে। আর বাংলাদেশিদের কাছে গল তো অহংকারের নাম। কারণ এ গল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ২০১৩ সালের টেস্টে প্রথম বাংলাদেশি হয়ে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম।
শ্রীলংকার বিপক্ষে ওই গল টেস্টে মোহাম্মদ আশরাফুল সংগ্রহ করেন ১৯০ রান এবং মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে রেকর্ড জুটি গড়েন। নাসির হোসেনও ১০০ রান করেন। এখন পর্যন্ত টেস্টে বাংলাদেশের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৬৩৮ রানের রেকর্ডও হয়েছিল ২০১৩ এর গল টেস্টে। আর ওই টেস্টে শ্রীলংকার সঙ্গে আমরা প্রথম ড্র করি।
গল শহরে অবস্থিত গল সমুদ্র সৈকত শ্রীলংকার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। ২০১৬ সালেই নাকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছয়টি সমুদ্র সৈকতের মধ্যে এটি অন্যতম ছিলো। আর এই গল সমুদ্র সৈকতে নিজেদের প্রথম সাগরতলের জাদুঘর উদ্বোধন করলো শ্রীলংকা।
শ্রীলংকার সাগরতলের এ জাদুঘরের অবস্থান পানির ৫০ ফুট নিচে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজা পাকসের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শ্রীলংকার নৌ বাহিনী নির্মাণ করেছে সাগরতলের এ জাদুঘর। ব্যতিক্রমধর্মী এ জাদুঘরে স্থাপনের জন্য মানব ভাস্কর্য তৈরি করেছে শ্রীলংকার নৌ বাহিনী। এই ভাস্কর্যগুলো তৈরিতে এমন সব উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে যাতে দীর্ঘদিন পানিতে থাকলেও এগুলো নষ্ট না হয়। ডাঙায় তৈরি করা প্রতিটি ভাস্কর্য যেনো মানুষের প্রতিমূর্তি। আছে মানুষের প্রতিচ্ছবি ছাড়া অন্যান্য ভাস্কর্যও। পরে ভাস্কর্যগুলো সাগরের তলদেশে স্থাপন করা হয়।
ভাস্কর্যগুলো সমুদ্রের নিচে সুন্দরভাবে স্থাপনও করে শ্রীলংকার নৌ বাহিনীর সদস্যরা। সমুদ্রের প্রবল ঢেউ বা ঝড় জলোচ্ছ্বাসে ভাস্কর্যগুলো যাতে উপড়ে না যায় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে শ্রীলংকার নৌ বাহিনী। সমুদ্রের তলদেশে ভাস্কর্যগুলো কেউবা দাঁড়িয়ে, কেউবা টেবিলের পাশে বসে আছে। প্রত্যেকের দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থাকার মধ্যে নিজস্ব অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। দেখে মনে হবে এ যেন জলের নিচে জীবনেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ভিডিওতে দেখা যায় ভাস্কর্যগুলোর আশপাশে বাহারি রঙের মাছ ও জলজ প্রাণী ঘুরঘুর করছে। আসলে মাছগুলোর বুঝে ওঠার উপায় নেই এরা আদৌ জীবন্ত মানুষ কিনা। আর তাই মাঝে মধ্যে এসব মূর্তি বা ভাস্কর্যে মাছগুলো এসে ঠোকর মারছে সত্যিকারের মানুষ ভেবে। এমনকি ভাস্কর্যগুলোর আশপাশে দানা বাঁধছে প্রবালও! সামুদ্রিক প্রবাল সংরক্ষণে এ সামুদ্রিক জাদুঘরের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলেও জানিয়েছে শ্রীলংকার নৌবাহিনী।
এ জাদুঘরে ডুবুরি বা ডাইভারদের জন্য কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা নেই, অবাধে সাঁতার কাটা যাবে। পর্যটকরা গ্লাসের মেঝেওলা বোট, স্কুবা ডাইভিং ও ডাইভিং মাস্ক পরে পানির ভিতরে সাঁতার কেটে জাদুঘরটিতে যেতে পারবেন। এটি পর্যটকদের একটি ‘নতুন ধরনের’ জাদুঘরের অভিজ্ঞতা দিবে বলে আশা কর্তৃপক্ষের।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ভিডিওতে দেখা যায় সাগরের নিচেই শ্রীলংকার নৌ বাহিনীর কমান্ডার ভাইস অ্যাডমিরাল পিয়াল দে সিলভা ফিতা কেটে জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করছেন। আর তাকে ফিতা কাটার কাঁচি সববরাহ করছেন মৎস্যকন্যা। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য!
শ্রীলংকার গল সমুদ্র সৈকত এমনিতেই পর্যটকদের কাছে অনেক জনপ্রিয়। এবার তাতে যুক্ত হলো সাগরতলের জাদুঘর। পর্যটকদের জন্য সাগরতলের এই যাদুঘর যে নতুন আকর্ষণ হবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলাই যায়।
গলের ডুবো জাদুঘর শ্রীলংকার তো বটেই দক্ষিণ এশিয়ারও প্রথম সাগরতলের জাদুঘর।
তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্ডানের আকাবা সমুদ্র উপকূলে সাগরতলের সামরিক জাদুঘর উদ্বোধন করা হয় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ২০১৮ সালে চালু করা হয় ‘আন্ডারওয়াটার মিউজিয়াম অব আর্ট’ (ইউএমএ)। স্পেনে রয়েছে ইউরোপের প্রথম ডুবো জাদুঘর ‘মুসেও আতলান্তিকো লানজারোতে’ এবং মেক্সিকোর কানকুনে আছে সাগরতলের জাদুঘর ‘মুসেও সুবাকোয়াতিকো দে আর্তে’।
লেখক: পিএইডি গবেষক, মেসি ইউনিভার্সিটি, নিউজিল্যান্ড
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply