শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১০ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক : বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত নগরী কক্সবাজারে এটা একটা নিয়মতান্ত্রিক অভিযোগ, পর্যটক বাড়লে এখানে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা চলে। কক্সবাজারের আবাসিক হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস, রেস্তোরা, যানবাহন চালকরা পর্যটকদের কাছ থেকে যে-যেমন পারে অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন।
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। টানা ৩ দিনের ছুটিতে কক্সবাজার ভ্রমণে আসা পর্যটকদের মুখে মুখে এখন এমন অভিযোগের পাহাড়। শুক্র ও শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটে। আর রোববার বড়দিনের ছুটি। এ ৩ দিনের ছুটিতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় কক্সবাজারে।
কক্সবাজারের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এ ৩ দিন কক্সবাজারে গড়ে ২ লাখ করে ৬ লাখ পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছেন। অথচ কক্সবাজারের আবাসিক হোটেলে ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষের। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর মৌসুমী ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্তভোগী এবং অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের কবলে পর্যটকদের অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। যার কারণে পুরো কক্সবাজার নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে নৈতিবাচক ধারণ তৈরী হচ্ছে।
শনিবার ও রোববার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, কলাতলী হোটেল মোটেল জোন সহ কয়েকটি পর্যটক স্পটে প্রতিবেদক কথা বলেছেন ভ্রমণে আসা অর্ধ শত পর্যটকের সাথে। সকল পর্যটকই একই কন্ঠে বলেছেন, কক্সবাজারে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়কে পুঁজি করে হোটেল কক্ষ ও গাড়ী ভাড়া, খাবার রেস্তোরায় অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন। আর সেবা ও খাবার মান নিয়েও সন্তোষ নন তারা।
রাজধানী ঢাকা থেকে আসা চাকুরিজীবী তরুণ মাহাদুল আবসার জানান, এটা তার কক্সবাজারে আসা প্রথম নয়, এর আগেও অসংখ্যবার তিনি কক্সবাজার এসেছেন। এবার এসে হোটেলের ভাড়া নেয়া হয়েছে অনেক বেশি। তবে আগে যে সেবা বা সার্ভিস তিনি পেয়েছেন তা পাচ্ছেন না। ওয়াচ রুম নষ্ট, রুমের লাইটও জ্বলে না। অভিযোগ দিলে হোটেল কর্তৃপক্ষ বলেছেন “থাকলে থাকেন, না থাকলে বের হয়ে যান।” এটা পর্যটন সেবা হতে পারে না।
জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এক পর্যটক জানান, গত ২ দিন ধরে যে সব রেস্তোরায় তিনি খেয়েছেন সব ক’টায় মূল্য অতিরিক্ত নিয়েছেন। এর আগে অন্যান্য বার এসে খাবার সময় এমন বেশি মূল্য নিতে দেখা যায়নি।
এ মূহুর্তে পর্যটকের চাপ অনেক বেশি মন্তব্য করে শাহেদ নামের কুমিল্লার এক পর্যটক জানান, হোটেলে যে কক্ষটি ৩ হাজার টাকা হওয়ার কথা তা নিতে হয়েছে ৫ হাজার টাকায়। অতিরিক্ত পর্যটকের ভিড়ে বাধ্য হয়ে তিনি অতিরিক্ত ভাড়ায় হোটেলে থাকতে হচ্ছে।
কলাতলীর আল আরম নামের একটি হোটেলে আড়াই হাজার টাকা করে ৪ রুম ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন চাঁদপুরের আবদুল ওয়াজেদ সহ তার দল। তিনি জানান, খুব নি¤œমানের হোটেল এটি। এ হোটেলের ভাড়া কোন ভাবেই ৫ শত টাকা বেশি হওয়ার কথা না। অনেকটা বিপদে পড়ে এই হোটেলে তাদের অবস্থান নিতে হচ্ছে।
কক্সবাজারের কলাতলী থেকে হিমছড়ির দূরত্ব ১০ কিলোমিটারের বেশি মন্তব্য করে রফিক নামের এক পর্যটক জানান, হিমছড়ি যাওয়া-আসার জন্য একটি জিপ গাড়ি ভাড়া নিতে হয়েছে ৬ হাজার টাকায়। এটা ২ হাজারের বেশি হওয়ার কথা না।
নিজের নাম ঠিকানা প্রকাশ না করে একপর্যটক জানান, কলাতলীর আরআরএম নামের একটি গেস্ট হাউসে ৮ শত টাকার একটি রুম ভাড়া নিয়ে ৪ হাজার টাকায়। আর প্রতিষ্ঠানটির সেবা বলতে কিছু নেই। বালিশ, কম্বল দেয় না, রুম অপরিষ্কার। কিছু বললে প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্বপ্রাপ্তরা গালিগালাজ করেন।
আর এসব পর্যটকের সকলেই বলেছেন, অভ্যন্তরে যাতায়তের ক্ষেত্রে ইজিবাইক, রিক্সা চালকরাও অতিরিক্ত টাকা আদায় করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের নজরধারী দেয়া দাবি জানান তারা।
বৃহত্তর বীচ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সদস্য আব্দুর রহমান জানান, কক্সবাজারের আবাসিক হোটেলে ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষের। আর এখন তার অতিরিক্ত পর্যটক কক্সবাজার এসেছেন। প্রতিবারই ছুটিকে কেন্দ্র করে শ্রেণীর মৌসুমী ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্তভোগী তৈরী হয়। এরা কৌশলে হোটেলের কিছু রুম অগ্রীম বুকিং দিয়ে রাখেন। পর্যটকরা আসলে অতিরিক্ত মূল্যে তা বিক্রি করেন। ফলে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগটি বারবার আলোচনায় আসে।
তিনি জানান, ছুটিতে ভ্রমণ না, ভ্রমণের জন্য ছুটি নেয়া জরুরী। কক্সবাজারে আগত পর্যটকদের আসার আগে হোটেল রুম নিশ্চিত করা জরুরী। আর ধারণ ক্ষমতার বেশি পর্যটক আসে এমন সময় ভ্রমণে না আসা উচিত। একই সঙ্গে রুম ভাড়া নেয়ার সময় এটা প্রতিষ্ঠানের মালিক না কি ভিন্ন মানুষ তাও যাচাই করা উচিত। এতে পর্যটকরা হয়রানী থেকে রেহায় পাবেন। পর্যটক সচেতন হলেই অভিযোগ আসবে না।
বাংলাদেশ রেস্তোরা মালিক সমিতি কক্সবাজার জেলার সভাপতি নঈমুল হক চৌধুরী টুটুল জানান, কক্সবাজারে তাদের সমিতিভ‚ক্ত রেস্তোরার সংখ্যা ১৩৪ টি। আর প্রতিটি রেস্তোরা সমুহ জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা থেকে নিবন্ধন করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের টেবিলে-টেবিলে, রেস্তোরার দৃশ্যমান স্থানে খাবার মূল্য সহ তালিকা প্রদর্শন করা আসে। এরা কোনভাবেই অতিরিক্ত টাকা নিয়ে জেলা প্রশাসনকে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
তিনি বলেন, নিবন্ধনের বাইরে কলাতলী সহ আশে-পাশে এলাকায় ২ শতাধিক রেস্তোরা রয়েছে। যাদের কোন প্রকার বৈধতা নেই। এসব মৌসুমী ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের হয়রানী করছে। এদের তালিকা জেলা প্রশাসন ও রাজস্ব বিভাগে তিনি নিজেই জমা দিয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান জানান, পর্যটকদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষে কলাতলী ডেলফিন মোড়ে অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যদি কোনভাবেই কেউ হয়রানীতে শিকার হন অভিযোগ দেয়ার আহবান জানান তিনি।
তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply