বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:১৩ অপরাহ্ন
জাতীয় ডেস্ক : একাত্তরের যে দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল লক্ষ-কোটি প্রাণে, সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি।
সোমবার ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হচ্ছে বাঙালির জীবনের স্মরণীয় দিনটি।
জাতির মুক্তি সংগ্রামের স্বপ্নে ধারাবাহিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে ৫১ বছর আগের এই দিনে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে যে ভাষণ দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তা আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত।
তৎকালীন রেস কোর্সের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস ১৯ মিনিটে তুলে ধরে একাত্তরের সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়- ‘তারপর থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের’।
এরপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি শোষক, দখলদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আসে স্বাধীনতা।
সাতই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব বিবেচনায় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো এ ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজের’ মর্যাদা দিয়েছে।
ঐতিহাসিক এ দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে ৭ মার্চকে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন উল্লেখ করে বলেন, “স্বাধীনতা বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন। তবে তা একদিনে অর্জিত হয়নি। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের এই দীর্ঘ বন্ধুর পথে বঙ্গবন্ধুর অপরিসীম সাহস, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সঠিক দিকনির্দেশনা জাতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।”
আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর কালজয়ী ভাষণগুলোর অন্যতম। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তিকামী জনগণকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ওই ভাষণ ছিল এক মহামন্ত্র। একটি ভাষণ কীভাবে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলে, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তার অনন্য উদাহরণ।
রাষ্ট্রপতি বলেন, “স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন। মহান এ নেতার সে স্বপ্ন পূরণে আমাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণের বিশ্বস্বীকৃতি বাঙালি জাতির জন্য এক বিরল সম্মান ও গৌরবের স্মারক।
“জাতির পিতার ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণের বিশ্ব স্বীকৃতি আজ বাঙালি জাতির জন্য এক বিরল সম্মান ও গৌরবের স্মারক। ’৭৫ থেকে ’৯৬ সাল পর্যন্ত এদেশে এই ভাষণ প্রচার নিষিদ্ধ ছিল, যেমনটা করেছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী- তারাও সেদিন রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে এ ভাষণ প্রচার করতে দেয়নি। কিন্তু সত্য সর্বদাই অনিরুদ্ধ। তাই, নিপীড়িত-নির্যাতিত বাঙালিদের মুক্তির এই মহামন্ত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়- বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হচ্ছে, অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “গত বছর আমরা এই মহাভাষণের সুবর্ণজয়ন্তী এবং আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। এ বছর আমরা ভাষা-আন্দোলনের ৭০ বছর এবং মুজিববর্ষ উদযাপন করছি। এমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণে আমি গভীর শ্রদ্ধায় প্রথমেই স্মরণ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদ, দু’লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন এবং অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে- যাদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।”
রেসকোর্সে সেদিন
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা সেদিন ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন।
ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল বিশাল ময়দান। মুহুমুর্হু গর্জনে ফেটে পড়েছিলেন উত্থিত বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। বাতাসে উড়ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা।
বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু সেদিন দৃপ্তপায়ে উঠে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানান অপেক্ষমান জনসমুদ্রের উদ্দেশে।
তারপর শুরু হয় সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।
কবিতার পংক্তির মতো তিনি বলে চলেন- “… আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।”
বঙ্গবন্ধু বলেন, “…সৈন্যরা, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।”
উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব, তখন এরপর বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত আদেশ- “তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”
সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে দেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি।
রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সব আয়োজন ছিল ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষের। প্রচার শুরুও হয়েছিল। কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রচার বন্ধ করে দিলে বেতারের সব বাঙালি কর্মচারী বেতার ভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের সম্প্র্রচার কার্যক্রম।
ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে নানা গুজব। গভীর রাতে অবশ্য সামরিক কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর পূর্ণ ভাষণ সম্প্রচারের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply